যখন করোনায় প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড হচ্ছে, যখন মানুষ করোনায় মাস দুয়েক ধরে চলা জীবন ও জীবিকার লড়াই নিয়েই বড় ক্লান্ত ঠিক তখনই মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে সুপার সাইক্লোন ‘আম্পান’ এর থাবায় জনজীবন বিপর্যস্ত। এখন পর্যন্ত পাওয়া সরকারী সুত্রমতেই, আম্পানে ইতিমধ্যেই দেশে ২৬ জেলায় অন্তত ১.৭৬ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল, ফল, সবজি,নষ্ট হয়ে গেছে, মাছ ভেসে গেছে,সেই সাথে ভেঙ্গে গেছে লাখ লাখ বাড়িঘর ও ৭ কিমি বেড়িবাঁধ। আর প্রানহানির ব্যাপারে বলতে গেলে শুধু যশোর জেলাতেই ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছেন ১২ জন মানুষ। অনেকেই এখনো পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখন একদিকে করোনায় বহুদিনের কর্মহীনতা আবার অন্যদিকে ‘আম্পানে’ স্বজন হারা, ঘর হারা, ফসল হারা এই সব মানুষ এই উভয় সংকট মোকাবেলা করবে কি করে? এখন সরকারই বা কি করবে?
করোনা অদৃশ্য ভাইরাস,আমাদের কাছে নতুন তাই এর মোকাবেলায় ‘লকডাউন’ ‘সামাজিক দূরত্ব’ এর মতো নতুন বিষয়গুলো আমাদের বুঝে নিয়ে তারপর মোকাবেলা করতে অনেক সময় লেগেছে এবং লাগছে কিন্তু আম্পান এর মতো ঝড় দৃশ্যমান ও আমরা বহুকাল থেকেই এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর আগের এবং পরবর্তী সময়টা সফলতার সাথে মোকাবেলা করে এসেছি, তাই এই সংকট মোকাবেলায় আমাদের মানুষের নিজস্ব স্থানিক জ্ঞান, অতীতের সফলতার কৌশল কিংবা ব্যর্থতার গল্প জানতে হবে। খুলনার যে কয়রায় আজ জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে চারিদিকের গ্রাম প্লাবিত,অনেক বছর আগে সিডরের পর সেই কয়রায় গিয়ে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম,সেখানে সিডরের পর মানুষের মাঝে ভাতের জন্য হাহাকার ছিলোনা, হাহাকার ছিল পানির জন্য। মানুষ রিলিফ হিসেবে চাল, ডাল এর বদলে সবার আগে পানি চেয়েছে। এখন করোনার সময়ে এই আম্পানে হয়তো তাঁদের চাহিদা কি হতে পারে সেটা মানুষের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে, অতীত অভিজ্ঞতা জেনে সেই অনুয়ায়ী সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ইতিমধ্যেই আম্পান এ ক্ষতিগ্রস্থ প্রত্যেক জেলার জন্য ৫০০ বান্ডিল টিন ও ১৫ লাখ টাকা সাহায্য হিসেবে ঘোষণা করেছে কিন্তু পরবর্তীকালে সাহায্যের সময়ে এইসব বিষয় বিবেচনা করা জরুরী যে, করোনার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার হয়তো সেখানে এই মুহূর্তে আম্পানের জন্য নিরাপদ খাবার পানির চেয়ে জরুরী না, আবার নগদ টাকা দিলেও বিপুল পরিমান নিরাপদ খাবার পানি হয়তো দোকানে পাওয়া যাচ্ছেনা ।
এক্ষেত্রে, আম্পান এর পূর্বেই এই ঝড় মোকাবেলায় সরকারী জনপ্রতিনিধি ও সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে করা কমিটি এর মতো করে এখন দুর্যোগ পরবর্তী সময়েও দ্রুত কৃষক, মাছ চাষি, শিক্ষক ও স্থানীয় রাজনৈতিক ও এনজিও প্রতিনিধিদের এলাকাভিত্তিক এই সমন্বয় কমিটিতে যুক্ত করা জরুরী। করোনা পরবর্তী সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা মোকাবেলায় যেখানে কৃষিকেই মূল হাতিয়ার মনে করা হচ্ছে সেখানে আম্পানে সেই কৃষক, সেই কৃষিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। তাই ‘যার যায় সেই বোঝে’ এই মূলনীতি ধরে যে কৃষক এর ফসল গেছে, যে চিংড়ি ঘেরের চাষি দিশেহারা, যে ফলবাগানের ফল ঝড়ে গেছে তাঁদের ক্ষতির সাপেক্ষে সরকার কি করলে তাঁরা এই করোনাকালীন সময়ে আবার দ্রুত উঠে দাড়াতে পারবেন, সেই পরামর্শ তাঁদের কাছ থেকেই সবার আগে নিতে হবে। এর পরেই হয়তো সরকার প্রয়োজন বুঝে দাওয়াই দেয়ার নীতি নিতে পারবেন।
সরকার ‘সামাজিক দূরত্ব’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত প্রায় দুইমাস ধরে ‘সরকারী ছুটি’ দিয়েছে, এর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য বড় অংকের অর্থনৈতিক প্রণোদনাও ঘোষণা করেছে এবং লাখের বেশি মানুষকে খাদ্য সাহায্য ও ৫০ লক্ষ মানুষকে সরাসরি আর্থিক সাহায্য দেয়ার প্রশংসনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে করোনায় সরকারের রিলিফ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে সুবিধাভোগী নির্বাচন থেকে ব্যাক্তি পর্যায়ে একজনের কাছে রিলিফ আসতে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রনালয় থেকে শুরু করে, জেলা, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি পর্যায়ে চেয়ারম্যান, মেম্বার এর ভূমিকা আছে। এর পাশাপাশি রিলিফ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকারী প্রজ্ঞাপন অনুসারে বিভিন্ন ওয়ার্ড কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি ও উপজেলা কমিটি গঠনের এর কথা আছে যার মধ্যে স্থানীয় নাগরিক, এনজিও প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের রাখার জন্য সরকার বলে দিয়েছে কিন্তু বাস্তবে এই রিলিফ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র যা আম্পানের পর আরও বড় পরিসরে এই রিলিফ কার্যক্রম কিভাবে বাস্তবায়িত হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। ইতিমধ্যেই দেশের প্রায় ৫০ এর অধিক জনপ্রতিনিধি সরকারী ত্রান বিতরণে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন, সরাসরি মানুষের মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে অশিক্ষিত, অসহায় গরীব মানুষের মোবাইল নম্বরের জায়গায় জনপ্রতিনিধি ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনের নম্বর দিয়ে রেখেছেন, যেগুলো ঠেকাতেই সরকার হিমশিম খাচ্ছে ।
অর্থাৎ একদিকে কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা সহ অনেকেই যারা এখনো সরকারী প্রণোদনার সুবিধা পান নাই তাঁরা কবে কখন কিভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে এই টাকা পাবেন সেটা নিয়ে দ্বিধায় আছেন, অন্যদিকে যে প্রক্রিয়ায় মানুষ সাহায্য পাচ্ছেন সেটার শতভাগ স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন সামনে এসেছে। এরমধ্যেই এলো আম্পানের এই দুর্যোগ, তাতে করে নতুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষজন নষ্ট হওয়া ঘরবাড়ি, ফসল, ফলাদি ইত্যাদি এর জন্য সরকারী সুবিধার আওতায় আসবেন কিনা? আসলেও, ইতিমধ্যেই করোনাতে ক্ষতিগ্রস্থ যে মানুষেরাই এখনো সরকারী রিলিফ পায় নাই, তাঁরা কিভাবে এখন আবার আম্পান এর জন্য সরকারী সুবিধার আওতায় আসবেন? এই সব নানা বিষয়ে সরকারকে দ্রুত নিজেদের চিন্তাভাবনা এই করোনা ও আম্পানে বিপর্যস্ত জনপদের মানুষকে জানাতে হবে এবং দ্রুত সাহায্য দিতে হবে। এতে করে সরকারের নিজের ইমেজ ও জনগণের দুর্যোগ পরবর্তী উঠে দাঁড়ানোর মনোবল দুইই বৃদ্ধি পাবে।
মোট কথা, করোনার এই দুঃসময়ে আম্পান বিভীষিকা। সরকার যেখানে করোনা মোকাবেলাতেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আম্পান এর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করতে হলে জনগণের জন্য নেয়া সরকারী পদক্ষেপে বিভিন্ন পর্যায়ের নাগরিকদের কাগজে কলমে নয় বরং কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা জরুরী। করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে মানুষের জন্য নেয়া সরকারের প্রণোদনার ধরন ও বাস্তবায়ন, সুবিধাভোগী নির্বাচন, রিলিফ বণ্টন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে নেয়া নীতি নিয়ে যে প্রশ্ন সমূহ সামনে এসেছে এখন আরও অধিকতর সংকটে সেগুলো নিয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া জরুরী। একই সাথে করোনার এই সময়ে আম্পানের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সমাধান খোঁজার আগে স্থানীয় মানুষের কথা শোনা জরুরী। সবশেষে বলতে চাই, করোনার মাঝেই এসেছে ‘আম্পান’, এই মহা দুর্যোগকালীন সময়ে সরকারী কার্যক্রমে শুধু স্বচ্ছতাই নয় বরং ন্যায্যতা নিশ্চিত করা আরও বেশি জরুরী।
মোঃ মাহান উল হক, গবেষক, ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অফ গভন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
Photo credit: Cyclone Sidr 2007-Bangladesh from Direct Relief licensed under CC BY-NC-ND 2.0