Blog

মানুষ বড় কাঁদছে: সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ‘হেল্প’ প্রতিষ্ঠা

ভোলা ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় অর্ধমিলিয়ন গবাদি পশু প্রাণ হারায়। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি ঘূর্ণিঝড় হয়। এতে প্রাণ হারান উপকূলের প্রায় ৩০০,০০০ জন মানুষ। এটিকে বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিজ্ঞানীরা যাকে ‘গ্রেট সাইক্লোন অব 1970’ নামেও অভিহিত করেন। এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্যার ফজলে হাসান আবেদ এবং তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীরা মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘হেল্প’ নামের একটি সংগঠন। প্রথম কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে এটি ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ ও পুনবার্সন কর্মসূচী পরিচালনা করে। শুরুতে হাতিয়াতে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হলে এর নাম হয় ‘হাতিয়া ইমার্জেন্সি লাইফসেইভিং প্রোজেক্ট’। পরবর্তীতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম মনপুরাতে স্থানান্তরিত করা হলে সংগঠনটির নাম পালটে ‘হার্টল্যান্ড ইমার্জেন্সি লাইফসেইভিং প্রোজেক্ট’ রাখা হয়। ‘হার্টল্যান্ড’ শব্দটি আসে মনপুরার ‘মন’ থেকে। শুরুতে ত্রাণ কর্মসূচী দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে তাঁরা ওই অঞ্চলে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করে। যা চলে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত। ‘হেল্প’ কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে স্যার আবেদকে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন, বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিটি। সংক্ষেপে ব্র্যাক।

‘ব্র্যাক ইতিহাস প্রকল্প’- এর অংশ হিসেবে, সম্প্রতি ‘হেল্প’-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য কায়সার জামানের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান। তিনি ছিলেন এফএইচ আবেদের সহকর্মী ও বন্ধু। পরবর্তীতে ব্র্যাকের প্রথম বোর্ড সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এ-বছর ভোলা সাইক্লোনের ৫২ বৎসর। ওই সাক্ষাৎকার এবং প্রাসঙ্গিক লেখাপত্রের ভিত্তিতে কিভাবে তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ‘হেল্প’ সংগঠনটির জন্ম হয়, তার একটি সংক্ষিপ্ত বয়ান তুলে ধরবো।

কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্সিয়াল এক্সিকিউটিভের উপর একটি ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে,  ১৯৬৮ সালে স্যার আবেদ দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে প্রায় ১৭ বছর তিনি লন্ডনে কাটান। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে যোগদান করেন, চট্টগ্রামে। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি কোম্পানিটির ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই সময় কায়সার জামান কোম্পানিটির পার্সোনাল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁরা থাকতেন একই আবাসিক এলাকায়। কোম্পানির পক্ষ থেকে ওই বাড়িটি তাঁদের দেওয়া হয়েছিল। এর খুব নিকটেই ছিল চিটাগং ক্লাব। ১২ নভেম্বর সন্ধ্যায় স্যার আবেদ রুটিনমাফিক ক্লাবে যান। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। সারাদিন-ই আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। খাবার অর্ডার দিয়ে তিনি জানালার কাছে এসে বসেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঝোড়ো হাওয়া শুরু হলে ক্লাব সদস্যদের মধ্যে এ-নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে ঝড়ের খবর আসা শুরু হয়। তাঁরা ঘূর্ণিঝড়ে বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কা করেন।

পরদিন সকালে স্যার আবেদ তাঁর বন্ধু আইনজীবী ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর স্ত্রী রুনি খানের ফোন পান। রুনি তাঁকে জানান, শুক্রবারের সংবাদপত্রে তাঁরা আগের রাতে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে কিছু প্রতিবেদন পড়েছেন। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ৪০,০০০ হাজার। উল্লেখ্য, পুর্বপাকিস্তানে তখন নির্ভরযোগ্য কোন গণনা পদ্ধতি ছিল না। ফলে মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক ওঠে। রুনি আবেদকে জানান, তিনি, তাঁর বোন পুতুল এবং ক্যান্ডি রোডি ঘূর্ণিঝড় কবলিত মানুষদের সাহায্য করতে চান। এ ব্যাপারে তাঁরা স্যার আবেদের সহযোগিতা চান এবং তাঁর বাড়িটিকে ব্যবহার করার কথা বলেন। আবেদ তখন তাঁদেরকে চট্টগ্রামে আসার কথা বলেন। এবং তিনি চট্টগ্রামে অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহের কাজটি করবেন বলে জানান। এরপর স্যার আবেদ তাঁর বন্ধু, সহকর্মী, রোটারি ও লায়ন ক্লাবের স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর অনুজ সহকর্মী কায়সার জামানকে বলেন, ঢাকা থেকে তাঁর কিছু বন্ধু আসবে যারা ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকায় ত্রাণ-সামগ্রী বিতরণ করতে চান। তিনি তাঁদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারবেন কি না। কায়সার রাজি হন।

স্রোতে ভেসে যাওয়া এক মৃতদেহ টেনে তুলছেন এক কর্মী; ছবি: Larry Burrows (LIFE Magazine)

বিভিন্ন সূত্র থেকে আট টন ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে, ১৭ নভেম্বর ঢাকা থেকে রুনি, পুতুল ও ক্যান্ডি আবেদের বাসায় আসেন। পরবর্তীতে যুক্ত হন আইনজীবী ভিকার চৌধুরী, তৎকালীন কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কর্মরত জন রোডি, আল সোমার, স্যার আবেদের পুরনো বন্ধু জাকারিয়া খান, প্রমুখ। ১৮ নভেম্বর তাঁরা আবেদের বাসায় কিভাবে ত্রাণ-কর্মসূচী পরিচালনা করা হবে এ-নিয়ে খসড়া-পরিকল্পনা করেন। ক্যান্ডি জানান, তিনি তাঁর বন্ধুদের কাছ থেকে ৫,০০০ রুপি সংগ্রহ করেছেন যা তিনি সরাসরি ত্রাণ কবলিত এলাকায় পৌঁছে দিতে চান। তখন একজন রোটারিয়ান পরামর্শ দেন, এলোপাথাড়ি ত্রাণ বিতরণ না করে, যারা সত্যিকার অর্থেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সাহায্য দেওয়া যায় কিনা। কায়সার বিষয়টির সাথে একমত পোষণ করেন। ইতিমধ্যে তাদের দলে যোগ দেন, আমেরিকান দম্পতি কলেরা ল্যাবের ডাক্তার লিংকন চেন ও তাঁর স্ত্রী মার্থা চেন। ধীরে ধীরে দলটি ভারি হয়ে ওঠে।

এরপর চট্টগ্রামের স্থানীয় বাজার থেকে বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী যেমন শাড়ি, লুঙ্গি, সাবান ও অন্যান্য জিনিসপত্র কেনা হয়। স্যার আবেদ শেল অয়েল কোম্পানি থেকে একটি স্পিডবোটের ব্যবস্থা করেন। তাঁর বাড়ির গ্যারেজকে ব্যবহার করা হয় ত্রাণসামগ্রীর গুদামঘর হিসেবে। বার্মা ইস্টার্ন থেকে ২০০ টিন কেরোসিন, ও অন্যান্য ত্রাণ-সামগ্রী নিয়ে দলটি জাহাজে করে প্রথমে হাতিয়ায় যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, সাইক্লোনটা শুধুমাত্র চট্টগ্রামে হয় নি। ভোলার দিকে আরও খারাপভাবে হয়েছে। বিশেষ করে মনপুরার অবস্থা আরো ভয়াবহ। দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে সেখানে এখনও পর্যন্ত কোন ত্রাণ-সামগ্রী পৌঁছায় নি। সেখানে অনেক মানুষ না খেয়ে আছেন। সঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারলে যারা জীবিত আছেন, তাদেরকেও বাঁচানো সম্ভব হবে না। এ-পর্যায়ে তাঁরা মনপুরায় ত্রাণ-কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত দেন। ফাদার টিমকে সঙ্গে নিয়ে আবেদ ও তাঁর দল অতি দ্রুত মনপুরায় পৌঁছান। উল্লেখ্য, টিম তখন নটরডেম কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

মনপুরায় যাওয়ার পর বিধ্বস্ত জনপদ দেখে তাঁরা সবাই বিমুঢ় হয়ে যান। স্যার আবেদ এটাকে তাঁর জীবন পাল্টে দেওয়া অভিজ্ঞতা হিসেবে অভিহিত করেন। ৩৫ বছরের যুবক আবেদের কাছে তাঁর সুবিধাজনক কর্পোরেট জীবনকে অর্থহীন বলে মনে হয়। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন:

সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। মানুষ, পশু-পাখি, সবকিছু। আমি বেশ ধাক্কা খাই। এই বিপন্ন দরিদ্র মানুষগুলোর জীবন দেখে মনে হয়েছিল, যে ধরণের জীবন আমি যাপন করছি, সেটার আসলেই কোন মানে আছে কিনা।

উল্লেখ্য, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত না থাকায়, ঘূর্ণিঝড়ের খবর ঢাকায় এসে পৌছায় তিনদিন পর। খবর পেয়ে ঢাকা থেকে বিভিন্ন অঙ্গনের পেশাজীবীদের একটি দল ঘূর্ণিঝড় কবলিত দুর্গম এলাকায় পৌঁছান। এদের মধ্যে ছিলেন রাজনীতিবিদ, নারী-কর্মী, স্বেচ্ছা-সেবক গোষ্ঠী, শিল্পী, গায়ক, শিক্ষার্থী প্রমুখ। তাঁদের প্রত্যক্ষ বয়ানে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত মনপুরার একটা চিত্র আমরা দেখতে পাই। সে প্রসঙ্গে লিখেছেন গবেষক আবু আহসান (ভাষান্তরিত):

একটা উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে ঘূর্ণিঝড়-বিধ্বস্ত এলাকা পাখির চোখে পর্যবেক্ষণ করছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় দায়িত্বরত আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড -এর  স্ত্রী মেগ ব্লাড। প্রথম দর্শনে দ্বীপটিকে তাঁর ‘বিন্দু বিন্দু কিশমিশময় সুবিশাল এক চকোলেটের পুডিং’ বলে মনে হয়। আরো  নিকটবর্তী হলে তিনি বুঝতে পারেন, কিশমিশ নয় এগুলো মূলত হাজার হাজার মানুষ এবং পশুর মৃতদেহ। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ফেরত এক মার্কিন সেনাকর্তা এই দৃশ্য দেখে বিহ্বল হয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করেন : এমন বীভৎস দৃশ্য তিনি জীবনেও দেখেন নি। উপকূলীয় অঞ্চল থেকে বেশ দূরে, পটুয়াখালিতে পৌঁছান বাংলাদেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ কামাল হোসেন। তিনি দেখেন, গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে- মৃত মানুষ ও পশুর মাংসের অবশিষ্টাংশ। অঙ্গাঅঙ্গি লেপ্টে আছে পচতে থাকা মাংসপেশী। এর মাঝে কোনটা মানুষের, কোনটা পশুর আলাদা করার উপায় নেই। তাঁর  মনে হয়, পচা মাংসের পরিচিত বিকট দুর্গন্ধে বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডক্টর রেহমান সোবহানও দক্ষিণের দুর্গম এলাকাগুলো চষে বেড়ান। তিনি গ্রামীণ ল্যান্ডস্কেপে এক পিনপতন নীরবতা অনুভব করেন : কোন শিশু কাঁদছে না। কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে না।  যেন সমস্ত প্রাণীকুল যেন ধ্বংস হয়ে গেছে। যেন-বা এ এক শিশুহীন দ্বীপ…কেবল হাতে গোনা কয়েকটি শিশু বেঁচে ছিল। স্থানীয় এক সংবাদপত্রে খবর বেরোয়, ‘ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত অঞ্চলে শিশুদের পোশাক পাঠাবেন না। কোন শিশু বেঁচে নেই।’  বিপুল ক্ষত আর ক্ষতির সাক্ষী হয়ে রয় এই শিরোনাম।

কামাল হেঁটে হেঁটে একটা নদীর তীরে এলে দেখতে পান, ‘হাজার হাজার গবাদি পশুর মৃতদেহ ঢেকে দিয়েছে মানুষের গুচ্ছ গুচ্ছ মৃতদেহ। পরস্পরকে আলিঙ্গন করে তারা মিলিমিশে একাকার।’  অজস্র মৃত মুখ, সমুদ্রের আকস্মিক আক্রমণের মুখে বিস্ময় ও অভিঘাত তাড়িত মানুষ, জীবিত প্রাণের বাঁচার আপ্রাণ আর্তির এক মায়াবীকরুণ প্রেক্ষাপটে, পুরো মহূর্তকে তার স্থির চিত্রের মতো মনে হয়। ক্ষুধার্ত কিছু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ খুঁজে পান তিনি। পুরো একটি গ্রামের শেষ অবশিষ্ট অধিবাসী তারা। প্রতি ঘন্টায় ধেয়ে আসা একশো চুয়াল্লিশ কিলোমিটার বাতাসের বেগ-কে প্রতিহত করে, গাছের মাথায় উঠে, চোখ মুখ শক্ত করে, ডাল আঁকড়ে ধরে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা। দুর্যোগের অব্যবহিত পরে মাটিতে তাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট ছিল না আর। চাল নেই, চুলা নেই, লবণ নেই, জ্বালানি নেই। নেই রান্নার ব্যবস্থা, আগুন জ্বালানোর কোন উপায়। শুধু নিজেদের খাওয়ার জন্য পড়ে ছিল কিছু শস্যদানা। এমনকি গ্রামের একমাত্র নলকূপ- সেটিও রেহায় পায় নি প্রকৃতির এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে। আর কোন উপায় না পেয়ে, মৃতদেহে পরিপূর্ণ একটা পুকুর থেকে দূষিত পানি পান করেছিল পিপাসার্তরা। হঠাৎ চারপাশ বিষণ্ণ, স্তব্ধ হয়ে ওঠে।  বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত এক জনপদের চারদিকে তখন কেবল ক্ষুধা, মৃত্যু, আর্তি, হাহাকার।

উল্লেখ্য, তখনকার মনপুরা ছিল একটি ঘন-বসতিপূর্ণ অঞ্চল। জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩২,০০০ (মতান্তরে ৩৬,০০০)। ঘূর্ণিঝড়ের পর সেখানে মাত্র ১৩,০০০ হাজার মানুষ বেঁচে ছিলেন। এ-পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, শেখ মুজিবুর রহমান মাওলানা ভাসানী, কবি সুফিয়া কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকা পরিদর্শন করছেন। এবং দীর্ঘদিন সে এলাকায় কাজ করছেন। মনপুরা থেকে ফিরে জয়নুল আবেদিন আঁকেন তাঁর বিখ্যাত ম্যুরাল ‘মনপুরা’৭০।

এরকম একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর, পাকিস্তান সামরিক সরকারের উদাসীনতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়। অবশ্য ০৮ নভেম্বর থেকেই আবহাওয়াবিদরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন। রেড-অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল উপকূলীয় অঞ্চলে। কিন্তু গ্রামবাসী বিষয়টিকে অতোটা গুরুত্বসহকারে নেন নি। কারণ, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ এমন আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচিত। তারা এটাকে স্বাভাবিক ঝড়-বৃষ্টি হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। এমনকি ঝড়ের দিন গ্রামবাসী একটা বিয়ের অনুষ্ঠানও আয়োজন করেছিলেন। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে ছিল নির্লিপ্তি ও অবহেলা। তখন ডেইলি স্টারে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী এবং শিক্ষাবিদ ডক্টর হামিদা হোসেন। ঘূর্ণিঝড়ের প্রাক্কালে সরকারি চাকুরিজীবীদের মাঝে এক উদ্ভট ‘উৎসব আমেজ’ লক্ষ্য করেন তিনি। তাঁর বয়ানে আমরা পাই :

‘গ্র্যান্ড এশিয়ান হাইওয়ে র‍্যালি’ তে  যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেক জেলা থেকে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা তখন দলে দলে ঢাকায় আসছিলেন। একদিকে উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের আসন্ন বিপদবার্তা, অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এরকম উৎসবমুখর পরিবেশ আমাকে বিষ্মিত করে। ঘূর্ণিঝড় নিয়ে রাষ্ট্রের ভেতরে তাত্ক্ষণিক কোন তৎপরতা বা সামান্যতম অনুভূতি আমি দেখতে পাই নি।

পাকিস্তানের সংবাদপত্রেও ঘূর্ণিঝড়ের খবরটিকে তেমন গুরুত্বসহকারে ছাপা হয় নি। ১৩ নভেম্বর ‘দ্যা পাকিস্তান অবজার্ভার’ নামে পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক একটি জাতীয় দৈনিক, ঝড়ের তীব্রতাকে ‘মাঝারি’ ও ‘অল্প প্রাণহানি’  মর্মে খবরে প্রকাশ করে। এর কয়েকদিন পর পূর্ব পাকিস্তানের স্থানীয় সংবাদদাতাদের মাধ্যমে ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘দ্যা ডেইলি মিরর’-এ একটি সংবাদ প্রকাশ পেলে ঘূর্ণিঝড়ের খবর প্রথম আন্তজার্তিক মহলে পৌঁছায়।

ভোলা সাইক্লোন নিয়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম। ছবি: দ্য ডেইলি স্টার

বিভিন্ন সংবাদপত্রে ঘূর্ণিঝড় বিষয়ক সংবাদ; ছবি: পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ডন’

ইয়াহিয়া খান তখন ক্ষমতায়। ঘটনার দু’তিন দিন পর তিনি ঢাকায় আসেন এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনালে অবস্থান করেন। সে-সময় তাঁকে ভোলা সাইক্লোনের চেয়ে বরং ব্যক্তিগত বিলাসের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়। এ নিয়ে মানুষের মনে বিভিন্নরকমের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ’৬৮ থেকে পূর্বপাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের যে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল, ’৬৯-এর গণঅভ্যুথান হয়ে ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর তা আরো প্রবল আকার ধারণ করে। ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় কাজ করে শেখ মুজিব বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই বিজয়ের পেছনে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের এই ঘুর্নিঝড়কে অবহেলার কারণটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভোলা সাইক্লোনের একটা রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে।

যাইহোক, প্রথমে স্যার আবেদ ও তাঁর দলের চিন্তা ছিল ৫-৬ দিন এভাবে সহযোগিতা করা। কিন্তু মনপুরায় যাওয়ার পর তাঁরা অনুভব করেন যে, তাঁদের আরো ত্রাণ-সামগ্রী প্রয়োজন। তখন মার্থা, ভিকার এবং রোডি ঢাকায় চলে আসেন এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে তাঁরা ত্রাণ সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। ঐ সময় মার্থা চেনের প্রতিবেশি ছিলেন একজন আমেরিকান। যিনি পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছিলেন। মার্থা তাঁর কাছে মনপুরার জন্য এক মিলিয়ন রূপি অনুদান চান। অন্যদিকে স্যার আবেদ ও অন্যরা মনপুরায় থেকে যান। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কবি সুফিয়া কামালের। তিনিও মনপুরাতে ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমরা দেখবো, স্যার আবেদ যখন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করছেন, সুফিয়া কামালকে ব্র্যাক-এর প্রথম চেয়ারম্যানশিপের দায়িত্ব দিচ্ছেন।

ওই সময় ‘এ ব্রেড ফর দি ওয়ার্ল্ড’ নামে জার্মানির একটি সংগঠনের কয়েকজন কর্মকর্তা মনপুরা পরিদর্শনে আসেন। এই সংস্থাটিই পরবর্তীতে ব্র্যাককে মানিকগঞ্জে কাজ করার জন্য তহবিল প্রদান করেছিল। তাঁরা আবেদ ও তাঁর দলের ত্রাণ-তৎপরতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তখন আবেদ জানান যে, তাঁদের আরও ত্রাণসামগ্রী এবং অর্থ প্রয়োজন। এ সময় তাঁরা একটি কর্ম-পরিকল্পনা চান। তাৎক্ষণিকভাবে মনপুরায় একটি সার্ভে করা হয়। এবং সেই সার্ভে থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে তাঁদেরকে একটি কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি করে দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে যে কোন কাজের আগে একটা গবেষণা করার এই চর্চাটি ব্র্যাক সবসময় বজায় রেখেছে। তথ্য-ভিত্তিক সেই কর্ম-পরিকল্পনাটি পেয়ে সংগঠনটি তিন মিলিয়ন ডয়েচ মার্ক অনুদান দেওয়ার কথা জানায়। এভাবে ধীরে ধীরে ত্রাণ-কার্যক্রমের পরিসর বৃদ্ধি পায়। একটা পর্যায়ে গিয়ে কার্যক্রমটিকে একটি সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার চিন্তা করা হয় এবং দলের ভেতর থেকে একটা নামের প্রস্তাব আসে। এ প্রসঙ্গে কায়সার জামানের বয়ানে আমরা পাই :

আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম যে, সাইক্লোনটা শুধুমাত্র হাতিয়াতে হয়েছে। পাঁচ-ছয়দিন এভাবে সহযোগিতা করবো। কিন্তু লোকজন এমনভাবে আমাদেরকে টাকা দিল। তখন খুশি কবির বা অন্য কেউ একজন আমাদেরকে বললেন যে, আমাদের একটা নাম দেওয়া উচিৎ। এমনিতে তো বন্ধুরা মিলে ইনফরমালি কাজটা আমরা করছি, কিন্তু একটা নাম দেওয়া দরকার। তখন নাম দেওয়া হলো- হাতিয়া ইমার্জেন্সি লাইফসেভিং প্রোজেক্টআমরাই প্রথমে নন-প্রফেশনাল চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশন, যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে যাচ্ছিলাম।

পরবর্তীতে ‘হেল্প’ নামে দলটি তাঁদের ত্রাণ-কার্যক্রম পরিচালনা করে। সংগঠনটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন এফএইচ আবেদ এবং সদস্য হিসেবে থাকলেন মার্থা চেন, ক্যান্ডি রোড, এবং ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী। স্যার আবেদের অনুরোধে পাকিস্তান সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত উপ-সচিব আকবর কবীর সমন্বয়কারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অন্যদিকে আবেদ নটর-ডেম কলেজের বোর্ডের কাছে ফাদার টিমের ছুটির ব্যাপারে চিঠি লেখেন এবং তাঁকে মনপুরায় ফিল্ড কোঅর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করেন। অন্যদিকে ত্রাণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একজন মাঠ সমন্বয়কারীর প্রয়োজন হলে কায়সার জামানকে শেল কোম্পানি থেকে দুই মাসের ছুটি নেওয়ার কথা বলেন। আবেদের পরামর্শ মোতাবেক শেল থেকে দুই মাসের ছুটি নিয়ে কায়সার ফিল্ড-কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব নিয়ে মনপুরা চলে যান। কাজগুলো সমন্বয় করার জন্য ঢাকায় একটা ‘অনানুষ্ঠানিক অফিস’ খোলা হয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবকরা সেখানে কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন।

ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড উপকূলীয় অঞ্চল, ছবি: গেটবেঙ্গল ডট কম

এ-সময় বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীরা মনপুরায় এসে দেখতে পান, ত্রাণ কর্মসূচীর সমস্ত কাজ স্বেচ্ছাসেবীরাই করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কেউ নেই। বিবিসিতে বিষয়টি নিয়ে এক ধরণের সমালোচনা ওঠে যে, এত বড় একটা সাইক্লোন হওয়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনরকম পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। বিদেশি সংস্থা তখন কাকে টাকা দেবে এ-নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। আমেরিকান সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ ‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় লেখেন, ‘ত্রাণ কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা থাকলেও, একমাত্র ‘হেল্প’ নামের একটি সংগঠন সেখানে পরিচ্ছন্নভাবে কাজ করছে।’ তিনি এও উল্লেখ করেন যে, ‘এ-পর্যন্ত যত ত্রাণ কর্মসূচী পরিচালিত হয়েছে তার সবই করেছে এই সংস্থাটি।’ খবরটি প্রধান দাতাসংস্থাদের নজর কাড়ে। তাঁরা জানতে পারেন ‘হেল্প’ নামে নতুন একটি সংস্থা কাজ করছে। ধীরে ধীরে অনুদানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ‘হেল্প’-এর ত্রাণ কার্যক্রম নজরদারি করার জন্য সামরিক সরকার গোয়েন্দা নিয়োগ দেয়। তাঁরা এখানে কোনরকম দুনীর্তি হচ্ছে কিনা বিষয়টি যাচাই করে।

ত্রাণ কার্যক্রম যখন প্রায় শেষের দিকে তখন আমেরিকান অ্যাম্বেসি থেকে ‘হেল্প’কে আরো কিছু অর্থ অনুদান দেওয়া হয়। একই সাথে কিছু জার্মান সহায়তাও পাওয়া যায়।

তখন শীতকাল চলছিল। ‘হেল্প’-এর কর্মীরা দেখতে পান, যাদের ঘর-বাড়ি নেই তারা খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছেন। কেউ কেউ গাছতলায় ঘুমাচ্ছেন। তখন তাঁরা আরো কিছুদিন ওই অঞ্চলে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং মনপুরায় ত্রাণ কার্যক্রমের পাশাপাশি পুনর্বাসন-এর চিন্তা করেন। বরিশাল থেকে ঘরবাড়ি বানানোর জন্য বাঁশ, খুটির সহ বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে আসা হয়।

ওই সময়ের প্রেক্ষিতে, মনপুরা ছিল অত্যন্ত দুর্গম এক অঞ্চল। কঠিন প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে দলের প্রতিটি সদস্য সেখানে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেখানকার মানুষের প্রতি এক নিবিড় সমবেদনা তাঁরা অনুভব করেন এ প্রসঙ্গে জন রোডির বয়ানে আমরা পাই:

অবশেষে আমরা মনপুরায় পৌঁছাতে সক্ষম হই। চারদিকে লাশের গন্ধে আমরা ক্ষুধার কথা ভুলে যাই। পুরো একদিন না খেয়ে থাকার পর প্রথম রাতে আমরা কিছু ভাত রান্না করি। হঠাত চোখ পড়ে, একজন বাবার কোলে দু’টো ছোট ছেলে। ওরা আমাদের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। ছেলেদের কারো পরনে কাপড় নাই। বাবার পরনে এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়। আমি ওদের সামনে খাবার দিয়ে বললাম, তোমরা এটা খাও। অনেকক্ষণ ওরা কোন কথা বললো না। আমি আবার বললাম, কী ব্যাপার তোমরা খাচ্ছ না কেন? তখন ওদের বাবা উত্তর দেন: স্যার, আমরা বারোদিন ধরে না খেয়ে আছি। আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না এ খাবার আমাদের। এরপর তাঁরা গ্রোগ্রাসে খাওয়া শুরু করে।

মনপুরায় ‘হেল্প’-এর কার্যক্রম যখন চলছিল, তখন এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এরপর ‘হেল্প’-এর সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েন। স্যার আবেদ চলে যান লন্ডনে। কায়সার জামান চলে যান আমেরিকা। লন্ডনে আবেদ ‘হেল্প বাংলাদেশ’ ও ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখেন। অন্যদিকে আমেরিকায় ‘বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার’ নামে একটি লবিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কায়সার জামান সেখানে কাজ করেন।

সত্তরের ঘূর্ণিঝড় যেমন এ অঞ্চলের রাজনীতির বাঁক পরিবর্তনের জন্য ‘ট্রিগার পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করেছিল, তেমনি ‘হেল্প’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলে মানবিক কার্যক্রমের স্থানিক চর্চার বীজ বপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর দুর্গম শাল্লায় ‘ব্র্যাক’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্যার আবেদ সেটিকে আরো পোক্ত করেন।

সংকটকালে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ব্র্যাক পেয়েছে তার উন্নয়ন দর্শন। যেমন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন:

মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও,
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও,
মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।

ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা পর্যবেক্ষণ করছেন বেঁচে যাওয়া স্থানীয় জনগোষ্ঠী; ছবি: গেটবেঙ্গল ডট কম


লেখক রাব্বী আহমেদ, জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে যুক্ত আছেন ব্র্যাক এবং বিআইজিডি’র যৌথ উদ্যোগে চলমান হিস্ট্রিসাইজিং ব্র্যাক প্রোজেক্ট-এ। এই প্রকল্পটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান এবং ড. ইমরান মতিন। প্রকল্পটিতে আরও যুক্ত আছেন আবু আহসান, জুমানা আসরার ও শফিকুল ইসলাম।

তথ্যসূত্র:

১) অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান গৃহীত কায়সার জামানের সাক্ষাৎকার; ২০২১

২) হোপ ওভার দ্য ফেইট, স্কট ম্যাকমিলান; রৌম্যান অ্যান্ড লিটলফিল্ড, ২০২২

৩)  ফ্রিডম ফ্রম ওয়ান্ট, ইয়ান স্মাইলি; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৯

৪) ফর্মেশন অব ব্র্যাক: অ্যা হিস্টোরিক্যাল অ্যাকাউন্ট, আবু আহসান, সুমাইয়া ইকবাল; বিআইজিডি মনোগ্রাফ নং-১, এপ্রিল ২০২২

৫) ‘ব্র্যাক: ফর্মেটিভ ইয়ার্স’— শীর্ষক অধ্যাপক শাহাদুজ্জামানের বক্তৃতা, ২০২১।

৭) ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক, গোলাম মোর্তজা; মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৬

৮) ব্র্যাক উন্নয়নের একটি উপাখ্যান, ফারুক চৌধুরী, সুবল কুমার বণিক ও সাজেদুর রহমান; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৯

৯) শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; ২০১০

Up