২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পর দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে ঢাকার সংযোগ এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফজলে হাসান আবেদ তখন চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামে। ২৬ মার্চ তিনি তাঁর বাসা ছেড়ে এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেন। ২৭ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তারা জানান, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতারে যে ঘোষণা প্রদান করবেন তার একটা ড্রাফট প্রয়োজন।’ ওই দিন দুপুরে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ঘোষণাটি প্রচার করা হয়। এর কয়েকদিনের মধ্যেই চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সাথে চট্টগ্রামের সব রকমের যোগাযোগ। ১২ এপ্রিল সংযোগ পুনরায় শুরু হলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার সঙ্গে ‘স্টল-সার্ভিস’ (শর্ট টেক অব অ্যান্ড ল্যান্ডিং) চালু হয়। এ-সময়ে পিআইএ-এর ছোট কিছু বিমান চলাচল শুরু করে। তখনকার পরিস্থিতিতে বড় বিমানে চলাচল করা সম্ভবপর ছিল না। এছাড়া বিমান বন্দরের রানওয়েও ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। কাজেই এই ছোট বিমানগুলোকে আনা হয়েছিল।
এ-সময় স্যার আবেদ ‘স্টল-সার্ভিসে’ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। উল্লেখ্য, সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষাপটে আবেদ ও তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীরা মিলে ‘হেল্প’ (Heartland Emergency Livesaving Project) নামে যে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার হেড অফিস ছিল ঢাকায়। ‘হেল্প’-এর কার্যক্রম তখনও চলছিল। এবং এ-কাজে আবেদকে প্রতি সপ্তাহেই ঢাকায় আসতে হতো। একই সময় শেল কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যান জেনারেল আবদুর রহিমও ঢাকায় আসেন। তিনি ঢাকায় আবেদের অবস্থানের কথা জানতে পারেন। এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটা মিটিং ডাকেন। মিটিং-এ জেনারেল রহিম জানান, টিক্কা খানের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক শাসক) সাথে এক আলাপচারিতায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে- চলমান যুদ্ধে শেল অয়েল কোম্পানি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ করবে। এবং এ-জন্য তেল কোম্পানিগুলো থেকে একজন লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগ দেওয়া হবে। যিনি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ-এর সদর দপ্তর (martial-law headquarters)-এ বসবেন, এবং পাকিস্তান আর্মির সাথে লিয়াজোঁ মেইনটেইন করবেন। তার কাজ হবে তেলের জাহাজ কখন আসবে, কোন জায়গা থেকে আসবে এবং কোন জাহাজের তেল কোথায় শোধন করা হবে এ বিষয়গুলো তদারকি করা। তিনি আরও জানান, আবেদ-ই হবেন শেল অয়েল কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিসার। তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহ করলে বিপদ হবে ভেবে আবেদ ঠাণ্ডা মাথায় কোম্পানির সিদ্ধান্ত মেনে নেন। এবং কিছুদিন কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর আবেদকে বাঘের ছাপ-ওয়ালা একটা পরিচয়পত্র (Martial law Identity Card) দেওয়া হয়। এটি ছিল ‘ফ্রি মুভমেন্ট পাস’ যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারতেন। উল্লেখ্য, ওই সময় সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তর ছিল গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন)। সেখানে আবেদকে পাকিস্তানি এক কর্নেলের সঙ্গে একই রুমে বসতে হতো। ওই কর্নেলের ছিল বাঙালি বিদ্বেষ। তিনি সবসময় বাঙালিদের নিয়ে অযৌক্তিক ও অশালীন কথাবার্তা বলতেন। এক পর্যায়ে আবেদ অনুভব করেন, এখানে থাকা তাঁর জন্য দূরহ হয়ে যাবে। তিনি তখন শেল কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করার চিন্তা করেন। এবং দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খোঁজেন। এপ্রিলের শেষ দিকে তিনি জানতে পারেন আমেরিকায় তাঁর বন্ধুরা পাকিস্তানের প্রতি আমেরিকার সমর্থন বন্ধ করার জন্য তদবির করছে। সেই সময়ে একটা কাজে তিতাস গ্যাস ফিল্ডের অফিসে গেলে সেখানে লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। শহীদুল্লাহ কায়সার তখন দৈনিক সংবাদ-এ চাকরি করতেন। স্যার আবেদের বয়ানে: অনেকটা ‘অভিভাবকসুল্ভ’ উচ্চারণে তিনি তাঁকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেন। এবং বলেন, ‘তাঁর মতো তরুণদের বিপদের সম্ভাবনা বেশি।’ আবেদের চাচা ছিলেন খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ সায়ীদুল হাসান। (আর পি সাহাকে মুক্তির চেষ্টা করার অভিযোগে একাত্তরের মে মাসে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হয়, তাঁকে হত্যা করে হয়েছে)। তিনি ভাসানী ন্যাপের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে তাঁদের এক ধরণের পারিবারিক যোগাযোগ ছিল। সব মিলিয়ে তিনি ভাবেন, এখন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় এসেছে।
ইতিমধ্যে আবেদের অনেক বন্ধু ও সহকর্মী ভারত না হয় অন্য কোনো দেশে চলে যায়। যেহেতু এর আগে দীর্ঘদিন তিনি ইংল্যান্ডে ছিলেন। ফলে সেখানে তাঁর পরিচিত দেশি-বিদেশি বন্ধু-বান্ধব ছিল। তিনি মনে করেন, তহবিল সংগ্রহ কিংবা জনমত গঠন যা-ই হোক লন্ডনে গেলে তিনি ভালোভাবে দেশের জন্য কাজ করতে পারবেন। সার্বিক বিবেচনায় তিনি লন্ডনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ওই পরিস্থিতে ঢাকা থেকে লন্ডন যাওয়া ছিল বেশ দুঃসাহসিক কাজ। ঢাকা থেকে লন্ডনের সরাসরি কোনো ফ্লাইট না থাকায় তিনি প্রথমে করাচি যাওয়ার জন্য একটা ছাড়পত্র নেন। (ওই সময় ঢাকা থেকে করাচি যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল)। করাচি বিমানবন্দরে নামার পর বাঙালিদের আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ‘মুভমেন্ট পাস’ থাকার কারণে সে যাত্রায় তিনি রেহাই পান। কিন্তু বিমান বন্দর থেকে তিনি যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন শেল কোম্পানির এক সহকর্মীর সাথে তাঁর দেখা হয়। ওই সহকর্মী করাচি এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। তিনি আবেদকে করাচি আসার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তখন আবেদ বলেন, তিনিও ছুটি কাটাতে এসেছেন। এ-সময় তিনি করাচিতে কিছুদিন থাকেন। এরপর সেখান থেকে ইসলামাবাদে আসাফউদ্দৌলাহ নামে তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে যান। আসাফউদ্দৌলাহ তখন পাকিস্তান সরকারের উপসচিব পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
পরদিন তিনি শেল কোম্পানির এক সহকর্মীর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। যিনি নিকটেই থাকতেন। এ-দিকে বিমানবন্দরে শেল কোম্পানির যে সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল, তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যানকে তাঁর ঢাকা ত্যাগ করার বিষয়টি জানান। তখন শেল কোম্পানির চেয়ারম্যান পাকিস্তান ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)—এর কাছে অভিযোগ করেন, তাদের কোম্পানির একজন বাঙালি অফিসার কাউকে না জানিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে এসেছে। তাকে যেন গ্রেফতার করা হয়। এই একই বার্তা পাঞ্জাবের গভর্নরের কাছেও পাঠানো হয়। খবর পেয়ে আইএসআই -এর কর্মীরা আবেদকে গ্রেফতার করেন এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শেল কোম্পানির ইসলামাবাদ অফিসে নিয়ে যান। এ-সময় আইএসআই-এর এক কর্নেল তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ-সময় তারা আবেদের জিনিসপত্র-ও তল্লাশি করেন। কিন্তু অভিযোগ করার মত কিছু না পেলেও বার বার তাঁকে ইসলামাবাদে আসার কারণ জিজ্ঞেস করেন। আবেদ প্রতিবারই বলেন, তিনি ছুটি কাটাতে এসেছেন। এ-সময় আইএসআই তাঁর কাছে সম্প্রতি পাওয়া প্রোমোশনের একটা কাগজ দেখতে পান। সেখানে তাঁর বেতনের কথা উল্লেখ ছিল (৪, ৯০০ রূপি/ ১০২৯ ডলার)। তখনকার প্রেক্ষাপটে এমন বিপুল অংকের বেতন দেখে আইএসআই-এর কর্মকর্তারা বিশ্বাস করতে পারেননি যে এত মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে তিনি চলে এসেছেন।