আনুমানিক ২৪ ফিট X ১২ ফিটের একটি ঘর, বাসিন্দা প্রায় ৩৫–৪০। দুই পাশে সারি সারি তোশক পাতা, মাঝখানে ব্যাগের স্তূপ, তার উপর একটি দড়িতে কাপড় ঝোলানো। যত্রতত্র পড়ে আছে বই-খাতা, বাটি, ওষুধপত্র, কাপড়-চোপড়সহ নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস। শুনতে শরণার্থী শিবিরের মতো মনে হলেও আদতে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এর একটি গণরুম। এই ঘরেরই একজন বাসিন্দা শান্ত। বাড়ি উত্তরবঙ্গে হওয়ায় থাকছেন আবাসিক হলে, তবে দ্বিতীয় বর্ষের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এলেও এখনো পাননি আবাসিক সিট। বাধ্য হয়েই তাই থাকতে হচ্ছে গণরুমে। এতজন এক ঘরে থাকার কারণে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন প্রায় প্রতিদিনই। তারপরও গণরুমে থাকতেই হয় কারণ গ্রাম থেকে আসা সীমিত আয়ের পরিবারের সন্তান শান্ত ঢাকায় চলেন টিউশনি করে। শহরে বাসা ভাড়া করা বা মেসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
শিক্ষার মান ও পরিবেশের ক্রমাগত অবনতি সত্ত্বেও দেশের অন্যতম সরকারি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাবি এখনও দেশের নানান অঞ্চলের—বিশেষ করে সীমিত আয়ের পরিবারের—শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে। ঢাবিতে ভর্তির পর স্বল্প খরচে বসবাসের জন্য শান্তর মতো এসব শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দ হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো।
কিন্তু পরিকল্পনাহীনভাবে নতুন নতুন বিভাগ সংযোজনের ফলে শিক্ষার্থী সংখ্যার মাত্রাহীন বৃদ্ধি এবং এর অনুপাতে হল সংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি ভুগছে তীব্র আবাসন সংকটে। যার ফলে ২০০৩ সালে “বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট” প্রথম বর্ষের কোনো শিক্ষার্থীকে আবাসিক সিট না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
আপাতদৃষ্টিতে আবাসন সংকটের পিছনে সিট ও শিক্ষার্থী সংখ্যার এই অসামঞ্জস্যকে মূল কারণ হিসেবে মনে করা হলেও সংকটের নেপথ্যে একটি প্রধান নিয়ামক হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হল দখল। নব্বই-উত্তর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ঢাবির ক্যাম্পাস দখলের একটি মূখ্য উপাদান হয়ে দাঁড়ায় আবাসিক হলগুলো দখল করা। এর অংশ হিসেবে হলে কারা থাকবে এবং আবাসিক সিটগুলোর বণ্টন কিভাবে হবে তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন।
ফলস্বরূপ, একদিকে ছাত্রনেতা ও অবৈধ শিক্ষার্থীরা হলে থাকার সুবিধাপ্রাপ্ত হন, যা আবাসন সংকটকে আরও প্রকট করে তোলে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন হলে সিটপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের, নিজ স্বার্থে কাজে লাগানোর সুযোগ লাভ করে। যেহেতু, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে সিট পাওয়ার সুযোগ নেই, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন তাদের গণরুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় এবং বিনিময়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।
একটি ক্ষুদ্র পরিসরের গুণবাচক গবেষণার অংশ হিসেবে শান্ত যে গণরুমটিতে থাকেন সেটি পর্যবেক্ষণ করা এবং ঘরটির কয়েকজন বাসিন্দার সাথে আমার আলাপ করার সুযোগ হয়েছে। ঢাবির একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে এবং গণমাধ্যমের বরাতে গণরুমের নানারকম অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানার সুযোগ আমার আগেই হয়েছে, যার সিংহভাগই মূলত নেতিবাচক। আমার দেখা গণরুমটির ক্ষেত্রেও এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো উঠে এসেছে। কিন্তু তার সাথে সামনে এসেছে নেতিবাচকতার আড়ালে লুকানো কিছু ইতিবাচক দিকও।
বর্তমান লেখায় আমি এই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়েই আলোচনা করবো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হলের রাজনীতির সাথে গণরুম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেহেতু এই লেখায় আমি শুধুমাত্র গণরুমের ভিতরের অভিজ্ঞতার উপর আলোকপাত করতে চাই, সেহেতু হলের রাজনীতির সাথে গণরুমের সম্পর্কের আলোচনা থেকে এখানে ইচ্ছাকৃতভাবেই বিরত থাকছি।
এত অল্প জায়গায় ৩৫ জনের বেশি বাসিন্দা বসবাস করায় অনুমিতভাবেই আমার দেখা গণরুমটির প্রধান সমস্যা জায়গার তীব্র অপ্রতুলতা। ঘরে জায়গা না হওয়ায় বাসিন্দারা প্রায়ই পালা করে কিংবা হলের পাঠকক্ষ বা রিডিং রুমে ঘুমান। পড়াশুনার কোনো অবস্থা বা পরিবেশ যে নেই তা বলাই বাহুল্য। ঘরটিতে কোনো ব্যক্তিগত জায়গা বা গোপনীয়তার বালাই না থাকলেও বাসিন্দারা তেমন একটা পাত্তা দেন না। তারা নিজের মতোই ব্যক্তিগত কাজগুলো করতে থাকেন। আমার পর্যবেক্ষণের সময় আমি দেখেছি প্রায় ১৫ জনের উপস্থিতি সত্ত্বেও একজন শিক্ষার্থী ঘরটিতে ভিডিও কলে তার বান্ধবীর সাথে কথা বলছেন। এছাড়া একজনের টি-শার্ট, মোবাইল চার্জার, হেডফোন, বইপত্র ইত্যাদি আরেকজন ব্যবহার করা তো একেবারেই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
স্বল্প জায়গায় ঠাসাঠাসি করে বসবাসের ফলে ঘরটির পরিবেশ তার বাসিন্দাদের জন্য অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। পুরো ঘরটি প্রচণ্ড অগোছালো, নোংরা এবং ধুলাবালিতে ভর্তি। এর উপরে খাঁড়ার ঘা এর মতো রয়েছে ছারপোকার বিষম যন্ত্রণা। এরকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ঘরটির অধিবাসীরা নিয়তই নানাবিধ অসুখে ভোগেন, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খোস-পাঁচড়া। বাসিন্দাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি ছারপোকা ও খোস-পাঁচড়ার কবলে পড়েননি। ছারপোকা তাড়ানোর জন্য বেশ কিছু পন্থা অবলম্বন করলেও লাভ হয়নি কোনোটিতেই। আর খোস-পাঁচড়ার জন্য তারা মলম ব্যবহার করেন, কিছুদিন ভালো থাকেন, তারপর আবার যে-কে-সেই। ঘরের ভিতরকার এই সমস্যাগুলোর বাইরে গেস্টরুম ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সমস্যা তো আছেই।
প্রশ্ন জাগতে পারে—এরকম মানবেতর পরিবেশে কেন থাকেন এই শিক্ষার্থীরা? প্রথমত, গণরুমে থাকতে কোনো টাকা লাগে না। গণরুমের বাইরে গাছপালাসমৃদ্ধ হলের নির্মল পরিবেশের মাঝে দিন যাপন করা, হলের মেসে কম খরচে খাওয়া, হেটেই ক্লাসে যেতে পারা ইত্যাদি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীরা উপভোগ করেন। গণরুমে থাকলে দ্বিতীয় বর্ষে শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে হলে আবাসিক সিটের বরাদ্দ লাভ করেন। আর একবার সিট পেয়ে গেলে হলে থাকার এই সকল সুবিধা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পাট চুকানোর পরও একজন শিক্ষার্থী ভোগ করতে পারেন। ঢাকা শহরে এরকম পরিবেশে নামমাত্র মূল্যে থাকা-খাওয়ার এই সুযোগের আশায় শিক্ষার্থীরা তাই শত কষ্টের পরও গণরুমে বসবাস করেন।
থাকা-খাওয়ার এই সুবিধা ছাড়াও গণরুম শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণরুমের অভিজ্ঞতা তাদের যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে শেখায় এবং তাদের মধ্যে ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের দক্ষতার উন্মেষ ঘটায়। যেহেতু গণরুমে একদম নিজের বলে প্রায় কিছুই নেই সেহেতু প্রত্যেকে প্রত্যেকের গল্পগুলো জানেন, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করেন এবং একে অপরের ভালো-মন্দে পাশে থাকেন। ঘরের কেউ যদি অসুখ কিংবা অর্থকষ্টে ভুগতে থাকেন, অন্যরা সাধ্যমত এগিয়ে আসেন। ক্লাস, পরীক্ষা, গেস্টরুম আর টিউশনের যাঁতাকল থেকে খানিক মুক্তির আশায় গণরুমে মাঝে মাঝেই সবাই মেতে উঠেন হাসি-ঠাট্টা আর গান-বাজনায়। কখনো আবার কয়েকজন মিলে রাতের বেলায় সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন শহর ভ্রমণে। গণরুমের বাসিন্দারা এভাবেই খুঁজে পান প্রকৃত বন্ধু, এভাবেই গণরুম হয়ে ওঠে নিজ বাড়ির পর সবচেয়ে আপন স্থান।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবাসিক বাসস্থানে বসবাস শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও শিক্ষায়তনিক বিকাশের ক্ষেত্রে কল্যাণকর বলে বিবেচিত। সেই বিচারে এটি স্পষ্ট যে গণরুম শিক্ষার্থীদের শিক্ষায়তনিক বিকাশের পথকে প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করে। পক্ষান্তরে গণরুমের অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত বিকাশের ক্ষেত্রে একদিকে ভীষণ অস্বাস্থ্যকর হলেও শিক্ষার্থীরা গণরুমে থেকে অর্জন করেন কিছু প্রয়োজনীয় জীবন-দক্ষতা। উপরন্তু, গণরুমে বসবাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি করে বন্ধুত্বের গভীর বন্ধন, যা তাদের সামাজিক বিকাশে রাখে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
গণরুমের যে সংস্কৃতি ঢাবিসহ দেশের অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যমান, তা নিঃসন্দেহে লজ্জার ও হতাশার। দেশের একজন তরুণ নাগরিক হিসেবে এ সংস্কৃতি আমাকে পীড়িত করে, ভাবায়। কিন্তু গণরুমের যে সর্বাঙ্গীন নিরাশাব্যঞ্জক ছবি আমার সামনে ছিলো, এই ক্ষুদ্র পরিসরের গবেষণার অভিজ্ঞতা সেই ছবিটিকে খানিকটা হলেও মুছে দিয়েছে। এরকম প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ পরিবেশে থেকেও গণরুমের বাসিন্দারা বন্ধুত্বকে খুঁজে নিচ্ছেন, ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশের পথ খোলা রাখছেন, এই চিত্র আমাকে আশান্বিত করে। গণরুমের এই সংস্কৃতি বিলুপ্ত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশের দ্বার আরও উন্মুক্ত হবে এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা নতুন দিনের আলোকবর্তিকা হবেন, এই আমার কামনা।
Jahid Nur is a Research Associate at BRAC Institute of Governance and Development (BIGD), BRAC University.