Blog

বাংলাদেশ ২.০: ভাবনার বিকাশ, বিকাশের ভাবনা

১।
সুখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, “ভাবো, ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।” চিন্তন বা ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে মানুষের জন্মলগ্নে। মানুষ জন্মের পর হতে ভাবতে শিখেছে, তখন থেকে প্রশ্ন করতেও শিখেছে। চিন্তন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশই হলো প্রশ্ন করা। প্রশ্ন তোলা ও উত্তর খোঁজার নিরন্তর যাত্রার মধ্য দিয়ে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হয়। বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষাপটে আমরা দেখছি, বর্তমানে দেশে সঠিক প্রশ্ন করার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। তবে, প্রশ্নটি সঠিক হলেও সেই প্রশ্নটি যাদের কাছে উত্থাপিত হচ্ছে, সেই কাঠামোটি কতটুকু সঠিক?

২।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেয়া তথ্যমতে, দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬৫ শতাংশ, অর্থাৎ নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী ৩৫ শতাংশ। ফলে, “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড” বা, ‘জনমিতিক লভ্যাংশ’ নেয়ার সুযোগ এখন বাংলাদেশের সামনে। বিপুল কর্মক্ষম এই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ কর্মশক্তিতে পরিণত করে তাদের কর্মসংস্থান বা অর্থৈতিক কর্মযজ্ঞে সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার ওপরই নির্ভর করছে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ পাওয়ার বিষয়টি। কেন “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড”-এর কথা এলো? কারণ, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক রূপান্তরের মূল চালক আমাদের বিশাল তরুণ গোষ্ঠী, যাদের বলা হচ্ছে জেন-জি (Gen-Z)। অবশ্য শুধু জেন-জি’রাই নয়, এর সাথে আগের দু’টি প্রজন্ম জেন-এক্স ও জেন-ওয়াই-ও এই জনমিতিক লভ্যাংশের হিস্যা। তারা দেখিয়েছে, প্রশ্ন কিভাবে করতে হয়, কোথায় করতে হয়। এই তরুণদলের অমিত সম্ভাবনার প্রমাণ হিসেবে আমরা একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন দেখেছি। দেখেছি দেশ গড়ার কাজে স্বেচ্ছাশ্রম, দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার নির্মোহ তাড়না, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকাঠামোকে ঢেলে সাজানোর প্রত্যয়। তারুণ্যের এই প্রবল জোয়ারকে কিভাবে দেশ গঠনে কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে বর্তমানে নানা ফোরামে নানাবিধ আলোচনা চলছে। অর্থাৎ, ভাবনার কাজটি এগোচ্ছে।

৩।
প্রশ্ন করা যাক, ১৫ বছর আগেকার তারুণ্য কেন সরব হতে পারে নি? কি এমন ঘটল যে, দেড় দশক ধরে শাসন করা আপাতদৃষ্টিতে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সরকার মাত্র ৩৬ দিনে ভেঙে পড়ল? কোথায় ছিল এত এত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আয়নাঘর, আর ক্ষমতা অপব্যবহারের কিসসা এবং বৈষম্যের বয়ান, যা এখন প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমে? উত্তর ঐ একটাই, প্রশ্ন করা যায় নি। বলা ভালো, প্রশ্ন করতে দেয়া হয় নি। প্রশ্ন উঠলেও সে প্রশ্নকে ধামাচাপা দিয়ে, প্রশ্নকর্তাকে নির্যাতন, হত্যা, বা গুম করে আমাদের কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে গত ১৫-২০ বছরে আমরা দেখেও দেখি নি, শুনেও শুনি নি, বলেও বলি নি। অর্থাৎ, দেশের জনগণ হিসেবে দেশে যা যা হয়েছে, তা আমরা হয় মেনে নিয়েছি, নয়তো সমর্থন করেছি। এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি)’র “টং আলাপ”-এ একটি গঠনমূলক আলোচনার সূত্র টেনে আনা যেতে পারে। “সমর্থন করা” ও “মেনে নেয়া”র মাঝে একধরনের পার্থক্য দেখিয়ে “টং আলাপ”-এর বক্তারা বোঝার চেষ্টা করেছেন, ঠিক কোন বিষয়টি সর্বস্তরের জনসাধারণের মনে অভ্যুত্থান ঘটানোর মত মানসিকতার সৃষ্টি করেছে।

৪।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “অভ্যুত্থানের চল্লিশ দিনঃ মানুষ কি ভাবছে?” শীর্ষক এক উন্মুক্ত আলোচনায় উপস্থিত বক্তা ও অতিথিদের বক্তব্যে আগামির বাংলাদেশে গনতান্ত্রিক রূপটি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে কমবেশি আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনা সভাটি ছিল মূলত “পালস সার্ভে ২০২৪: জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা, ও প্রত্যাশা” শিরোনামের একটি সদ্য প্রকাশিত সমীক্ষার ফলাফল জানানোর আয়োজন। সমীক্ষাটি আমাদের জানাচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি যেভাবে চলছে তা নিয়ে অধিকাংশ মানুষই আশাবাদী। শুধু তাই নয়, ছাত্র রাজনীতি, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা, নিরাপত্তা বাহিনির সংস্কার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার, এবং দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দৈন্য দূর করার ব্যাপারেও জনগণ সচেতন। যদিও জনসাধারণের এ সচেতনতা অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়, বরঞ্চ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আশাবাদ থেকেই উৎসরিত- তবুও, এই আশাবাদই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপরেখার প্রতিচ্ছবি। কারণ, ইতিহাস আমাদের বলে এর আগে যখন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বা ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছিলো, তখনও মানুষের মাঝে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে একধরণের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছিল। তখনও মানুষ সংস্কার চেয়েছে, চেয়েছে খেয়েপরে বেঁচে থাকার ন্যুনতম অধিকার। সেই অধিকার খর্ব যে বা যারাই করেছে, জনগণ তাদের শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।

৫।
জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতি চলেছে নানা বাঁকবদলের মধ্য দিয়ে। তবে, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ছাত্রজনতার আন্দোলন নানা কারণেই অন্য সকল আন্দোলন হতে প্রকৃতিতে আলাদা। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জেন-জি-দের একটা বড় ভূমিকা এ আন্দোলনে ছিলো, যা আগেকার আন্দোলনগুলোতে ছিলো অনুপস্থিত। একইসাথে কোটা সংস্কারের জন্য ২০১৩ ও ২০১৮ সালে রাজপথে নামা তরুণদের একটা বড় অংশকে দমিয়ে রাখা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় ভূমিকা ও পরিবহন নেতাদের উদাসীনতা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সীমাহীন দুর্নীতি ও স্ববিরোধী বক্তব্য, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি, উন্নয়নের নামে জনভোগান্তি ও লোক দেখানো উন্নতি মানুষ দীর্ঘসময় ধরে মেনে নিলেও একসময়ে এসে তা সমর্থন করে নি। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২৩ সালে বিআইজিডি-দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন পরিচালিত The State of Bangladesh’s Political Governance, Development and Society: According to Its Citizens সমীক্ষার ফলাফলে। ঐ সমীক্ষায় দেখা গেছে, সে সময়ই ৪৮ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত সম্পর্কে হতাশ ছিল। সময়ের সাথে সাথে মানুষের এই হতাশা বেড়েছে বৈ কমেনি।

তবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, যে আশা নিয়ে মানুষ আগে রাজপথে নেমেছিল তাদের সে আশা কখনো কখনো শেষ পর্যন্ত পূরণ হয় নি। আগস্ট অভ্যুত্থানের ব্যবচ্ছেদ হয়তো আমরা এখন নানাভাবে নানা লেন্সে করছি, ভবিষ্যতেও করবো। এই ব্যবচ্ছেদের মধ্য দিয়েই হয়তো আগামির বাংলাদেশে সুষ্ঠু গনতন্ত্রের বিকাশ হবে। সেই গণতন্ত্রে আমরা মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারব, স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করতে পারব, সেখানে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার ক্ষমতাও থাকবে। বাংলাদেশ ২.০-তে আমাদের এ ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে। জনমিতিক লভ্যাংশই বলি কিংবা আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথাই বলি, দেশ গড়তে ইতিবাচক যাই করতে চাই না কেন, সেটা করার সময় এসেছে এখন। এমন সময়, সুযোগ আর জনবল বাংলাদেশ এর আগে খুব একটা পায় নি। এখন সময়টি তাই ভাবার, ভাবনার প্র্যাকটিস করার; তারপর সেই ভাবনাকে কাজে পরিণত করার।

Up