Blog

আমিন ভাই ও ব্র্যাক : চলার বেগেই পথ কেটে যায় (দ্বিতীয় পর্ব)

আলোকচিত্র : মার্থা চে

গত ২ অক্টোবর ছিল আমিন ভাইয়ের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। দুই পর্বের এই লেখার মাধ্যমে আমরা আমিন ভাইয়ের শুরুর দিকের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রথম পর্বে ছিল-  আমিন ভাইয়ের ব্র্যাকে যোগদানের গল্প, রৌমারী, শাল্লা, জামালপুর, মানিকগঞ্জ- এর অভিজ্ঞতা, এবং আড়ং- শুরুর গল্প। দ্বিতীয় পর্বে রইলো- সত্তর দশকের শেষভাগে ব্র্যাকের কৌশলগত পরিবর্তন, আশির দশকে ব্র্যাকের আভ্যন্তরীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘পরিচ্ছন্নতা’ কার্যক্রম, রেশম চাষ বিষয়ক অভিজ্ঞতা এবং ব্র্যাকের আমিন ভাইয়ের নতুন কর্মধারা বিষয়ক বয়ান। প্রথম পর্ব পড়ুন-

ব্র্যাকের কৌশলগত পরিবর্তন

১৯৭৯ সালে ব্র্যাকের কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি নিয়ে সিনিয়র কর্মীদের মধ্যে এক ধরণের বিভাজন দেখা দেয়। ব্র্যাক তখন সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে সংগঠিত করার কাজ করছিল। এটিকে ‘আউটরিচ’ কর্মসূচী বলা হতো।  ব্র্যাকে তখন পাশাপাশি দু’টো ধারণা চলছিল। এক দল মনে করতেন প্রশিক্ষণ এবং ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদান করে দরিদ্র মানুষজনকে সংগঠিত করতে হবে যেন তারা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও শাসনবব্যস্থার সাথে সমঝোতার শক্তি অর্জন করতে পারে এবং ব্যাংকের কাছে ঋণ এবং সরকারের কাছে অন্যান্য দাবী আদায় করে নিতে করতে পারে। এবং এগুলো আদায়ে ব্যর্থ হলে সংগঠিত হয়ে সংগ্রাম করতে এবং বিদ্রোহ ও বিপ্লবের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অন্যদিকে অপর দলটি মনে করতেন যে দরিদ্র মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে হবে। এই লক্ষ্যে ব্র্যাক তখন আরসিটিপি (রুর‍্যাল ক্রেডিট এন্ড ট্রেইনিং প্রোজেক্ট) শুরু করার চিন্তা ভাবনা করে। বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমিন ভাই বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে বিশেষ আশাবাদী ছিলেন না। তিনি ভাবলেন, প্রথমে দরকার দরিদ্রদের আয়ের পথ সৃষ্টি করা, কারণ প্রথমত তাদের খাবার চাই। তারা যদি খাবারই না পায় কিংবা কোন প্ল্যাটফর্ম না পায় তাহলে তারা সংগ্রাম করতে পারবে না। আমিন ভাইয়ের বয়ানে আমরা পাই :

আমি অনুভব করছিলাম যে, সচেতনতা ঠিকই দরকার, কিন্তু একইসাথে আপনাকে দরিদ্রদের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি যাদের নিয়ে কাজ করে, তাদেরকে আমি দেখেছি। তারা সত্যিকারের দরিদ্র ছিল না। লেনিন শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেছেওই শ্রমিকরাও এদের মত দরিদ্র নয়, ভূমিহীন নয়। তাদের সংগ্রহে প্রতিদিনের, পরেরদিনের এবং একমাসের খাদ্য মজুত ছিল। আমি মাও সে তুং -এর বিল্পবও দেখেছি। তাঁর জনগণও এদের মত দরিদ্র ছিল না। আমি এ-সবের ভেতর দিয়ে গিয়েছি। আমি ভিয়েতনামকে দেখেছি। ভিয়েতনাম আমেরিকার বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলন শুরু করেছিল। হো চি মিন তাদেরকে সংগঠিত করেছিলেন। তিনি ভিয়েতনামকে কখনোই সংগঠিত করতে পারতেন না যদি না তাঁকে  আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হত। এবং চায়নাতে মাও সে-তুং কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন, দরিদ্র মানুষদের নয়। এক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন না যে তারা কমিউনিস্ট। তারা সত্যিকারের কমিউনিস্ট ছিল না। সেখানে কমিউনিস্ট সরকার ছিল। একারণে ওই সময়ে আমি এটার বিরোধীতা করেছিলাম।ওই সময়ে দু’জন মাত্র মানুষ আমাকে সমর্থন করেছিলেন। এদের একজন হলেন মার্থা চেন এবং আরেকজন আয়েশা আবেদ।

ওই সময়টায় ব্র্যাকএর বেশ বড় একটা দাতাসংস্থা ছিল—নোভিব (নেদারল্যান্ডস অর্গানাইজেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন)। প্রথম দলটি নোভিব-এর কাছে অভিযোগ করেন  যে, ব্র্যাক সঠিক পথে এগোচ্ছে না,  তারা (ব্র্যাক) ব্যুরোক্রেট, মাল্টিন্যাশনাল, ইত্যাদি, এবং নোভিবের অবশ্যই হস্তক্ষেপ করা উচিৎ। এর ভিত্তিতে নোভিব ব্র্যাক-এর কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য পাঁচ সদস্যদের একটা দল পাঠায়। দলটি বেলা আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত আমিন ভাইকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। একই সঙ্গে তাঁরা  ব্র্যাক বোর্ডে আবেদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। এই ঘটনায় ব্র্যাক বোর্ডের অনেক সদস্য পদত্যাগও করেন। পরবর্তীতে ব্র্যাক যেসব জায়গায় কাজ করছিল, সেখানে প্রথম গ্রুপটি রাজনৈতিক দলের মত বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করেন এবং ব্র্যাকের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। বিষয়টি জানতে পেরে আবেদ ভাই ওই গ্রুপের ২২ জনকে চাকরিচ্যুত করেন।

‘পরিচ্ছনতা’ কার্যক্রম

১৯৮৪ সালে ব্র্যাকের কিছু জায়গায় কিছুটা দুর্নীতি শুরু হয়। এই কাজটি করেছিলেন প্রথম  গ্রুপের একজন সদস্য যাকে তখনও  চাকরিচ্যুত করা হয় নি। ঐ কর্মী কয়েকজন ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের কাছ থেকে কিছু টাকা নেন এবং শেষমেশ ধরা পড়েন। তখন প্রত্যেকটা ব্রাঞ্চে এই মর্মে নোটিশ পাঠানো হয় যে, যদি কেউ তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ২,০০০ টাকা দেয় তাহলে তাকে ২০,০০০ টাকা জরিমানা করা হবে। দুইতিনটা ব্রাঞ্চে একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন আমিন ভাই প্রত্যেকটা ব্রাঞ্চ পরিদর্শনে যান এবং ওই কর্মীসহ এই ঘটনায় যারা সম্পৃক্ত ছিল তাদের সবাইকে বরখাস্ত করেন। একে  তিনি ‘পরিচ্ছন্নতা’ কার্যক্রম নাম দেন। এর ফলে কর্মীদের মোটিভেশন কিছুটা কমে গেলে ব্র্যাকের ব্যবস্থাপনাক্ষমতা এবং মোটিভেশন বাড়ানোর জন্য ক্যাথেরিন এইচ লোভেলকে নিয়ে আসা হয়। তিনি ১৯৯৫ সালে ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ট্রেইনিং-এ দেন।এর মাধ্যমে ব্র্যাক-এর কর্মীদের সক্ষমতা উন্নয়ন ট্রেইনিং-এর আরেকটি মাইলস্টোনের সূচনা হয় বলে আমিন ভাই-এর সাক্ষাৎকার থেকে আমরা জানতে পারি।

রেশম চাষ

১৯৭৬ সালে আমিন ভাইয়ের উদ্যোগে ব্র্যাক এন্ডি সিল্ক উৎপাদনের মাধ্যমে রেশমচাষ কার্যক্রমের সূচনা করেছিল। এর মাধ্যমে স্থানীয় দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের প্রথমদিককার কর্মী সুখেন্দ্র কুমার সরকার এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন :

রেশম, তুঁতগাছ এসমস্ত কিছু ঐ মানিকগঞ্জ থেকেই হয়েছে। তারপরে সমস্ত দেশে আমরা তার বিস্তার ঘটিয়েছি। তুঁত গাছ সম্পর্কে প্রথমে ধারণা ছিল যে রাজশাহী ছাড়া বোধহয় আর অন্য কোথাও এই গাছ হয় না। কিন্তু আমিন ভাই মানিকগঞ্জে এনে এটা প্রমাণ করেছেন যে এটা রাজশাহী ছাড়াও এটা হয়। পরে সারা বাংলাদেশেই তুঁতের প্রোজেক্ট চলেছে।

পরবর্তীতে ব্র্যাকের উদ্যোগে সারা বাংলাদেশে এক লক্ষ তুঁতগাছ লাগানোর মাধ্যমে দেশব্যাপী কর্মসূচীটির ব্যাপক বিস্তার ঘটানো হয়। সম্প্রতি গৃহীত এক সাক্ষাৎকারে মানিকগঞ্জের রাজীবপুর-কৃষ্ণপুর ব্রাঞ্চের ব্র্যাক সেরিকালচার কর্মসূচীর প্রাক্তন কর্মসূচী সংগঠক রেখা বেগম প্রায় চার দশক আগে মানিকগঞ্জে প্রথম রেশম চাষের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন:

আমার স্বামী জুয়া খেলতো। আমি ছিলাম খুব অসহায়। আমার সংসার চলতো না। উদ্ভ্রান্তের মত বিভিন্ন জায়গায় কাজের খোঁজ করছিলাম। এই সময় ব্র্যাক অফিসের সন্ধান পাই। আমার হাতে ছিল হাতের কাজ করা একটা রুমাল। এটা দেখে আমিন ভাই জিজ্ঞেস করেন এটা আমি করেছি কী না। আমি যখন বললাম যে এটা আমার করা তখন তিনি আমাকে কিছু হাতের কাজ দেন। এরপর ধীরেধীরে তিনি আমাকে সেরিকালচারে চাকরি দেন। আমাকে ট্রেনিং-এ পাঠান। আমি ফিরে এসে অনেক নারীকে ট্রেইনিং দেই। আমিন ভাইকে নিয়ে রাস্তার দুই ধারে আমরা তুঁত-গাছ লাগাই। দিন-রাত আমরাই গাছগুলোকে পাহারা দিতাম। ধীরে ধীরে আমার সংসারের উন্নতি হয়। এই কাজ করে আমি ছয় সদস্যের একটা পরিবার চালাতাম। আমিন ভাই আমাদের খুব স্নেহ করতেন। আমাদের জন্য উনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন।

আরডিপি’র সূচনা   

আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্র্যাক-এর দু’টো কর্মসূচী ছিল। এর একটি হচ্ছে আউটরিচ কর্মসূচী এবং আরেকটি হলো আরসিটিপি। ১৯৮৫ সালের দিকে ব্র্যাক সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী (আইআরডিপি) নামে আরেকটি কর্মসূচী চালু করে। আউটরিচ এবং আরসিটিপি’র পাশাপাশি এই কর্মসূচিটি মানিকগঞ্জ, জামালপুর, এবং শাল্লায় চলছিল। তখন এই তিনটি কর্মসূচী তিনদিকে পরিচালিত হচ্ছিল। আউটরিচ প্রোগ্রামের একটা অংশ ছিল সচেতনতা সৃষ্টি। কিন্তু সেখানে কোন ঋণ দেয়া হতো না। পক্ষান্তরে আরসিটিপিতে ঋণ দেওয়া হতো কিন্তু সচেতনতা সৃষ্টি করা হতনা। পরবর্তীতে ব্র্যাক ‘ক্রেডিট’ প্রোগ্রামকে আউটরিচের অন্তর্ভূক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং আরসিটিপি’তে সচেতনতা সৃষ্টি অংশ যুক্ত করে। পক্ষান্তরে আইআরডিপি’তে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ‘ক্রেডিট’ দু’টোই ছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে এই তিনটি কর্মসূচীকে একত্রিত করে ব্র্যাক পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী (আরডিপি) নামে একটা কর্মসূচী করার সিদ্ধান্ত নেয়। আরডিপি কর্মসূচী যখন বেশ ভালোভাবেই চলছিল ব্র্যাক তখন এর স্থায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করে এবং ১৯৮৮ সালে একটা প্রস্তাবনা দেয় যে, ব্র্যাক আরসিপি (রুরাল ক্রেডিট প্রোগ্রাম) এবং আরডিপি করতে পারে। চার বছর পর্যন্ত ব্র্যাক আরডিপি করবে এবং এরপরে আরসিপি করবে। আরিসিটিপি ছিল উপ-টেকসই এবং আরডিপিকে দাতাসংস্থা সহায়তা করছিল। ফলে ব্র্যাককে যদি আরসিপি’তে যেতে হয় তাহলে এটাকেও  উপ-টেকসই হবে। ফলে ব্র্যাক প্রথমবারের মত দাতাসংস্থার কাছে ১০০ মিলিয়ন ডলার তহবিল চায়। এটা ছিল খুবই উচ্চাভিলাষী একটা প্রস্তাব এবং তাই ব্র্যাক যখন দাতাসংস্থার কাছে এটা উপস্থাপন করে তখন সবাই বেশ অবাক হয়। এ সময়ে বিষয়টি নিয়ে ব্র্যাকের ভেতরে অনেক আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। তখন আরডিপি’র দায়িত্বে ছিলেন আমিন ভাই। এ বিষয়ে আমিন ভাইয়ের বয়ানে আমরা পাই:

এটা নিয়ে তখন আমরা অনেক আলাপ-আলোচনা করি। আবেদ ভাই অনেক ডোনার নিয়ে আসেন এবং এই বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন। প্রত্যেকেই বলেন, ‘এটা কি করে সম্ভব? আপনারা কিভাবে ১০০ মিলিয়ন, ৪২ মিলিয়ন, এবং ৩২ মিলিয়ন ডলার পাবেন?’ আমরা আরডিপি’র জন্য ৪৪ মিলিয়ন ডলার এবং আরসিপির জন্য ৩২ মিলিয়ন ডলার প্রস্তাবনা করেছিলাম। ডোনাররা এটা নিয়ে চিন্তিত ছিল কিন্তু তারা কিছু বলেনি। এরপর ডোনাররা জানায় যে, একবছরের মধ্যে এই টাকা তারা দিতে পারবেনা। তারা আরও বলে যে, এর জন্য অ্যাপ্রাইজাল এবং আরও ডোনার দরকার। কারণ ব্র্যাক-এর তখন মাত্র দু’টো বা তিনটা ডোনার ছিল। ফলে আমাদের আরো ডোনার এবং ডোনার কনসোর্টিয়াম দরকার পড়ে। এটা টেকসই নয় এই বিবেচনায় এসডিসি [সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশন] এসবের বিরুদ্ধে ছিল। যাইহোক, আরডিপি’র মাধ্যমেই ব্র্যাকের স্কেলআপ শুরু হয়েছিল।

আমরা দেখতে পাই এবিষয়টি নিয়ে তখন অনেক ধরণের তর্কবিতর্ক তৈরি হয়। ডোনারদের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে তারা আরডিপিকে যথারীতি এক বছরের জন্য বাড়াতে পারবেন। এ সময় ব্র্যাক  ডোনার কনসোর্টিয়াম এবং অ্যাপ্রাইজাল খোঁজা শুরু করে। ফোর্ড ফাউন্ডেশন তখন তহবিল জোগাড় করার জন্য ব্র্যাক-কে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে এবং প্রতিষ্ঠানটির সোশ্যাল ডেবিট প্রোগ্রাম ম্যানেজার আনিকা ম্যাগনুসন ব্র্যাক-এর পক্ষে ডোনার লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তিনি বিভিন্নধরণের দাতাসংস্থা এবং লোকজনের সাথে কথা বলেন। এবং অনেক দাতাসংস্থাই ব্র্যাককে তহবিল প্রদান করতে আগ্রহী হয়। এসময় ব্র্যাকের দু’টো অ্যাপ্রাইজাল হয় এবং এর মধ্য দিয়ে ব্র্যাক-এ প্রথমবারের মত অ্যাপ্রাইজাল সিস্টেম চালু হয়। পরবর্তীতে পরিস্থিতি বিবেচনা করে অ্যাপ্রাইজাল সদস্যরা বলেন যে, ‘হ্যাঁ, এটা হতে পারে।’ এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে ব্র্যাক আরসিপি এবং আরডিপি শুরু করে। ওইসময় ওডিএ (ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশন), সিডা, অক্সফাম, নোভিব, সুইডিশ সিডা, ক্যানাডিয়ান সিডা, এবং নোরাড (নরওয়েজিয়ান এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন)-কে ব্র্যাক দাতাসংস্থা হিসেবে পায়। আমিন ভাইয়ের নেতৃত্বে  চারটা পর্যায়ে আরডিপি হয়েছিল এবং আরডিপি-৪ ২০০২ সাল পর্যন্ত চলে। এরপর ২০০২ সালে ব্র্যাক অতিদরিদ্রদের জন্য  সিএফপিআর-টিউপি (চ্যালেঞ্জিং দি ফ্রন্টিয়ার্স অব পোভার্টি রিডাকশন- টার্গেটিং দি আল্ট্রা-পুওর) নামে আরেকটি কর্মসূচী চালু করে। একই সাথে আরডিপি-১ এবং আরডিপি-২- তে প্রাথমিকভাবে ব্র্যাক-এর একটা শিক্ষা কর্মসূচী ছিল যা আরডিপি-৩ থেকে আলাদা একটা কর্মসূচী হিসেবে চালু হয়। এরমাঝে তিনি ব্র্যাকের পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ১৯৯৭ সালে তিনি ব্র্যাকের ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (ডিইডি) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ব্র্যাকে নতুন কর্মধারা

আমিন ভাই যখন ব্র্যাকে কাজ শুরু করেন, তখন ব্র্যাকের বয়স মাত্র ০৩ বছর। ছোট্ট একটা সংস্থা, শাল্লা, জামালপুর, মানিকগঞ্জ বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। মানিকগঞ্জ ছিল ব্র্যাকের প্রধান পরীক্ষণ কেন্দ্র। আমিন ভাইয়ের বিবৃতিতে পাই, ব্র্যাকের স্বাস্থ্য সেবক/সেবিকা ধারণাটি এসেছিল মানিকগঞ্জ থেকে। ইউনিসেফের সাথে যখন ইপিআই (সার্বজনীন টিকাদান কর্মসূচী) করা হয়, তখন এটি সরকারপরিচালিত কর্মসূচী হলেও মানিকগঞ্জে স্বাস্থ্য সেবক/সেবিকাদের দিয়েই ব্র্যাক এটা করেছিল। ব্র্যাক ভেবেছিল গ্রামের স্বেচ্ছাসেবকরা এই জিনিসগুলো নিয়ে আগতে পারে এবং বিনামূল্যে এই কাজটা করতে পারে। এভাবে গ্রামের ভেতর একই সাথে তার গ্রুপসদস্য এবং স্বাস্থ্যকর্মী হতে পারবে। এই কাজের জন্য তাকে কোনো বেতন দেয়া হবে না। প্রাথমিকভাবে ২০০ জন সদস্য নিয়ে ব্র্যাক এটা শুরু করলেও পরবর্তীতে (ইয়ান স্মাইলিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সময়কাল অবধি) স্বাস্থ্য-কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭০,০০০ জন।

অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থায় ব্র্যাককে মানিকগঞ্জে তখন কাজ করতে হয়েছিল। মানিকগঞ্জে কাজ করার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা আমিন ভাইয়ের বয়ানে আমরা পাই:

খুব ছোট একটা বাড়িতে মানিকগঞ্জে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। এটি ছিল মূলত একটা গুদাম ঘর। কেউ আমাদেরকে কোন জায়গা দেয় নি। দিনের বেলা সেটাকেই আমরা অফিস হিসেবে ব্যবহার করতাম। আমাদের কোন ঘুমানোর জায়গায়ও ছিল না। কারণ রাতের বেলা পৌরসভার চেয়ারম্যান জায়গাটা দখল করে রাখতো। মানিকগঞ্জে যখন আমরা কাজ শুরু করি তখন ব্র্যাককে কেউ চিনতো না। আমি ছিলাম তখন ব্যাচেলর। এ কারণে কেউ আমাকে বাড়ি ভাড়াও দিত না।

পরবর্তীতে আমিন ভাইয়ের অনন্য চিন্তার প্রক্রিয়া, সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি, এবং নিপুণ পরিচালনাশৈলী ব্র্যাককে এগিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর। রৌমারী, মানিকগঞ্জের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তিনি যে অন্তর্দৃষ্টি পেয়েছিলেন সেগুলোকে তিনি ব্র্যাকের কর্মসূচীর বিকাশে কাজে লাগিয়েছিলেন। আমৃত্যু তিনি ব্র্যাকের বিস্তার ও কর্মধারার প্রসারে কাজ করে গিয়েছেন। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ যেমন বলেন:

ব্র্যাকের বিস্তার ও  কর্মধারার প্রসারঘটাতে আমি আর আমিন দু’জনেই সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। আমরা সর্বদাই ব্র্যাকের কর্মসূচী সম্প্রসারণের  চেষ্টা করেছি। আমিন না হলে আমাদের এই প্রসার হয়তো এতটা হতো না। ব্র্যাকে আমিনের উত্তরাধিকার দীর্ঘসময় ধরে থাকবে বলে আমি মনে করি। ব্র্যাকের কর্মীরা কর্মঠ ও পরিশ্রমী এর কিছুটা হয়েছে আমিনকে দেখে। বস্তুত ব্র্যাকে যে কর্মচঞ্চলতা তার নেতৃত্ব দিয়েছিল আমিন এবং তা এখনও চলছে।

আমিন ভাইয়ের উন্নয়নের ধরণ ছিল এদেশের মাটি ও মানুষের উপযুক্ত, যা পশ্চিমা উন্নয়ন ধারণা থেকে আলাদা। মানুষের সঙ্গে মিশে তিনি মানুষের প্রয়োজন বুঝতে চেয়েছেন, নতুন নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। কোন প্রচলিত তাত্ত্বিক কাঠামো নয় বরং সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন মাঠের মানুষের সাথে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, অজানাকে জানার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেন :

অজানাকে বশ ক’রে তুই করবি আপন জানা।

          চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী–

পায়ের বেগেই পথ কেটে যায়, করিস নে আর দেরি 

আমিন ভাইয়ের প্রয়াণ দিবসে তাঁ


লেখক রাব্বী আহমেদ, জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে যুক্ত আছেন বিআইজিডি ও ব্র্যাক-এর যৌথ উদ্যোগে চলমান ‘ব্র্যাক ইতিহাস প্রকল্প’-এ। প্রকল্পটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান এবং ড. ইমরান মতিন।

তথ্যসূত্র-
১) ইয়ান স্মাইলি গৃহীত আমিনুল আলম (আমিন)-এর সাক্ষাৎকার

২) মাঠের মানুষ : স্মরণে মোঃ আমিনুল আলম; অন্যপ্রকাশ, ২০১৮

৩) ব্র্যাক : উন্নয়নের একটি উপাখ্যান; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৯

৪) শাহাদুজ্জামান গৃহীত সুখেন্দ্রকুমার সরকারের সাক্ষাৎকার

৫) ফ্রিডম ফ্রম ওয়ান্ট, ইয়ান স্মাইলি; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৯

৬) ব্র্যাক-বিআইজিডি গৃহীত রেখা বেগমের সাক্ষাৎকার।

Up