Blog

কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য: না বলা কথা

রবিঠাকুরের বিখ্যাত ছোটগল্প “ছুটি”-র ফটিকের কথা মনে আছে? সেখানে বয়ঃসন্ধিকালীন বয়সের প্রতিভূ চরিত্র হিসেবে ফটিক সম্পর্কে যা বলা হয়েছিলো তা যেন আমাদের কিশোর-কিশোরীদেরই মনের কোটরবন্দী কথা, “তেরো-চৌদ্দ বছরের” ছেলেমেয়েরা “সর্বদা মনে-মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না… অথচ, এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়।“

এই ফটিকের মতই প্রায় সাড়ে তিন কোটি কিশোর-কিশোরীর বসবাস এই ছোট্ট দেশে যাদের বয়স ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। এই সংখ্যাটা নেহায়েত কম তো নয়ই বরং এই সংখ্যা আমাদের সমগ্র জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই দেশের সামগ্রিক মাপকাঠিতে এই জনগোষ্ঠীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেরকম কিছু কিশোর-কিশোরীর সাথে আমরা কথা বলি “জেন্ডার এন্ড এডোলেসেন্স: গ্লোবাল এভিডেন্স”, সংক্ষেপে GAGE প্রকল্পের আওতায় চলা গবেষণার সময়।

বয়ঃসন্ধি হচ্ছে ১০-১৯ বছরের বয়সসীমার মাঝে জীবনের এমন একটি ধাপ, যার মাধ্যমে একটি শিশুর প্রজনন ক্ষমতার পাশাপাশি শরীর ও মনে কিছু পরিবর্তন আসে এবং সে ধীরে ধীরে একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিণত হয়। ২০১৮-তে GAGE প্রকল্পের অধীনে ঢাকা-র তিনটি বস্তিতে একশোরও বেশি বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরী এবং তাদের পরিবার ও পারিপার্শ্বিক সমাজকে নিয়ে চালানো গবেষণায় উঠে আসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও চমকপ্রদ তথ্য।

তাদের সাথে কথা বলে দেখা গেছে, স্কুল পাঠ্যক্রমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ঠিকভাবে শেখানো হয় না। এই কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধির ব্যাপারে যথেষ্ট ধারণাও নেই। শতকরা ১৭ ভাগ কিশোর ও ২৭ ভাগ কিশোরী ঠিকমত কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির নাম বলতে পেরেছে। ১৫ বছর বয়সী কিশোর রফিক (ছদ্মনাম) আমাদের জানায়, “ক্লাস সিক্সে উঠে শারীরিক শিক্ষা বই থেকে আমরা জানতে পারি বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে।“ আদতে তাদের স্কুলের বইতে শুধু একটি অধ্যায়েই কৈশোরকালীন শারীরিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা রয়েছে, তাও কেবল মাসিক ও বয়ঃসন্ধি নিয়ে আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষকেরা যখন ক্লাসে মাসিক নিয়ে পড়ানো শুরু করে, তখন ছেলেদের ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হয়; যার ফলে তারা এ সম্পর্কিত জ্ঞান থেকে দূরেই থেকে যায়! এমনকি একজন কিশোরের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছেলেদের ক্ষেত্রে শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে বাবা কিংবা মায়ের সাথে আলোচনা করার বিষয়টিও ঘটে না লজ্জা ও সংকোচের কারণে। ছেলেদের ক্ষেত্রে তাদের মনোদৈহিক পরিবর্তন ও প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা বা জানার বিষয়টা সীমাবদ্ধ মূলত বন্ধুদের সাথে আলাপ কিংবা স্কুলের শারীরিক শিক্ষা বইয়ের সেই একটি অধ্যায়ে সীমিত জ্ঞান। মায়েরাও তাদের কন্যাসন্তানের সাথে খোলাখুলি আলাপ করতে স্বচ্ছন্দবোধ করলেও ছেলেসন্তানদের সাথে আলোচনা করতে মোটেই স্বচ্ছন্দ নন। একই কথা প্রযোজ্য কিশোরীদের ক্ষেত্রেও। তাদের অনেকেই বড়জোর মায়েদের সাথে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক আলাপ করে থাকে। শিরিন (ছদ্মনাম) নামের এক কিশোরী জানায়, কেবল বাবা-মা নয়, স্কুলের শিক্ষকরাও তাদেরকে প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষাদানের ব্যাপারে সংকোচবোধ করেন।

গেইজ-এর গবেষণায় দেখা গেছে, জরিপ চালানো ৩৯ শতাংশ কিশোরীর স্কুলে ঋতুকালীন সুবিধাগুলো পাওয়া যায়, যেই হার প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মেয়েদের প্রজননবিষয়ক স্বাস্থ্যসেবার জন্য এলাকার ঔষধের দোকান বা ফার্মেসীর ডাক্তারই প্রধাণ ভরসা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অধিকাংশই জানায় যে তাদের এলাকায় ধারেকাছে এমনকি ৫ কি.মি. দূরত্বের ভেতর কোনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিক নেই। কেউ কেউ দূরের সরকারী হাসপাতালে যায় তুলনামূলক কম খরচে ভালো স্বাস্থ্যসেবার জন্য। কেউবা রঙধনু সরকারী কমিউনিটি ক্লিনিকে কিংবা মেরি স্টোপ্স ক্লিনিকে অথবা এনজিও-পরিচালিত ক্লিনিকে যায়।

অর্থাৎ কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের প্রতুলতা দূরে থাক, সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণাই নেই। নেই সচেতনতা সৃষ্টির পর্যাপ্ত প্রয়াস, কিংবা স্কুল ও স্কুলের শিক্ষকদের সে সম্পর্কিত যথাযথ উদ্যোগ। মাসিক বা ঋতুস্রাব ও প্রজনন স্বাস্থ্য যেন এক ধরণের ট্যাবু।

ফটিকের মতই শিরিন ও রফিক কিংবা অন্য সব কিশোর-কিশোরীরা বয়ঃসন্ধির সময়টায় একরকমের জটিল পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়। গোটা দেশের এই সাড়ে তিন কোটি জনগোষ্ঠী তাদের কৈশোরকালীন সময়টা যখন পার করে, তখন কিন্তু তারা ঠিক আর শিশুদের কাতারেও পরে না, আবার প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেও তাদের গণ্য করা হয় না। তাদের জীবনের এই পর্যায়টা একটি সংবেদনশীল অধ্যায়। তাই তাদের প্রয়োজন একটুখানি যত্ন, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কিত যথাযথ জ্ঞান, সেইসাথে মেয়েদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত সুবিধা। উন্নত স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি এসডিজি অর্জনের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মোট জনসংখ্যার এই গুরুত্বপূর্ণ অংশকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়নের পথে সাফল্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

Photo credit: Sulekha.com licensed under CC BY-NC 2.0

Up