Blog

করোনা মহামারীকালীন সামাজিক সুরক্ষা ও নারী গৃহশ্রমিকদের টিকে থাকার কৌশল

Domestic workers in crowd protest by Maruf Rahman, made available by CC BY-NC-ND 2.0

গ্রাম থেকে নাজমা জীবিকার সন্ধানে ঢাকা শহরে আসেন। ঢাকা শহরে আসার পরে জীবনধারণের উপায় হিসেবে অন্য কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে তিনি মাসে ছয় হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। এই সীমিত অর্থ দিয়ে তিনি শহরে নিজের এবং গ্রামে তার উপর নির্ভরশীল ছেলেমেয়ে ও বৃদ্ধ মায়ের  ভরণপোষণ করেন। কিন্তু বিগত ১৮ মাস যাবত তিনি গ্রামে নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারেননি। কেননা করোনা মহানারীর কারণে বিশ্বের ৮০% গৃহকর্মীর মত তিনিও কাজ হারিয়েছেন।[1] কাজ হারানোর পরে নাজমা নানাভাবে টিকে থাকতে চেষ্টা করেছেন।

দফায় দফায় দীর্ঘ দিনের সাধারণ ছুটি এবং লকডাউন নাজমার মত দেশের প্রায় ২০ লক্ষ গৃহকর্মীর জীবনকে প্রভাবিত করেছে।[2] প্রথম আঘাত আসে তাঁদের জীবিকার উপর। অধিকাংশ গৃহকর্মী আকস্মিকভাবে তাদের কাজ হারান।  অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তার কাছ থেকে বকেয়া বেতন বা আপদকালীন সহযোগিতাও তারা পায়নি। আবার যেসকল গৃহকর্মী  কাজ হারাননি তাদেরকেও দীর্ঘদিন বিনাবেতনে অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়। মহামারী শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই অপ্রাতিষ্ঠানিক এই কর্ম খাতে নিয়োজিত অসংখ্য গৃহকর্মী কর্মহীন হয়ে পড়েন। আর এইসঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে মহামারিকালিন সময় গৃহকর্মী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য বিশেষ কোন আপদকালীন  সুরক্ষা  নীতিমালা ও প্রনদনা সহায়তা প্রদান করা হয়নি । যদিও রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় সকল ধরনের শ্রমজীবীদের সুরক্ষা প্রদানের কথা উল্লেখ করা রয়েছে।

২০১৫ সালে প্রণীত ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা আওতায় গৃহকর্মে নিয়োজিত কর্মীদের নিরাপত্তাপ্রদানের সাথেসাথে তাদেরকে ছুটি, প্রণোদনা এবং আপদকালীন ও জরুরি  সময়ে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।[3]  কিন্তু সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালায় নির্দেশনা দেওয়া থাকলেও এই মহামারীকালীন সময়ে গৃহকর্মীরা  কোন ধরনের আয় এবং কর্ম  নিরাপত্তা পাননি। অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত কর্মীদের মত গৃহকর্মীরাও জাতীয়ভাবে কোন ধরনের সুরক্ষা ও  প্রণোদনার  আওতাভুক্ত হননি ।[4] ফলে করোনাকালে তারামানবেতর জীবনযাপন করছেন।

তাঁরা পরিবারসমেত কোনোরকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। আর এই তথ্যগুলো উঠে এসেছেজীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং সংকট মোকাবেলা নারী গৃহশ্রমিকদের করোনা মহামারী কালীন সময় টিকে থাকা (Livelihood Transitions and Coping with Shocks: Women in the Domestic Service Sector Coping with COVID-19 ) শীর্ষক আমাদের একটি গুণগত গবেষণায়।

গবেষণায় অংশ নেওয়া ৩০ জন গৃহকর্মীর সকলেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই  কাজ হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন।

নুরজাহান (২৬) এই গবেষণায় অংশ নেওয়া একজন গৃহকর্মী। করোনাভাইরাস  সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর  প্রতিদিনের মতো নুরজাহান যখন তার কাজে যান, তখন তার নিয়োগকর্ত্রী তাকে জানিয়ে দেন, “কাল থেকে কাজে এসো না এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছে তুমি বস্তি এলাকা থেকে আসো তোমার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারে আবার সব কিছু ঠিক হয়ে গেলে তোমাকে ডাকবোএই এক কথায় তাঁর দীর্ঘ তিন বছরের চাকরিটি চলে যায়।  নুরজাহান আক্ষেপ করে বলেন, নিজের কথাডা কওনের সুযোগডাও পাইনাই ! এই  বিপদের সময় কি করমু, কি খা্মু !” এরপর থেকেই শুরু হয় নুরজাহানের  মহামারীকালীন অভিযোজনএবং টিকে থাকার প্রচেষ্টা।

আমাদের এই গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই গৃহকর্মীদের অনেকেই কাজ  হারানোর পরে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রধান যুক্তি ছিল, গ্রামে অন্তত তাদের দু’মুঠো খাবারের সংস্থান হবে। গ্রামেস্থানীয়ভাবে  কুড়ানো শাক-সবজি এবং আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে সংগৃহীত খাদ্য সামগ্রীর মাধ্যমে  তাদের তাৎক্ষণিক খাদ্য চাহিদা পূরণ হচ্ছে।

আর যেসকল গৃহকর্মীরা গ্রামে ফেরত যেতে পারেননি, তাঁদের জন্য টিকে থাকা ছিল অনেক বেশি  কঠিন। তাঁদের খাদ্যসংকট ছিল তীব্র। শুরুর দিকে অনেকে বাজার থেকে কমদামে  নিম্নমানের পণ্য  ক্রয় করে পরিবারের খাদ্যচাহিদা পূরণ করেছেন। আর  যাদের ক্রয় সামর্থ্য ছিল না, তাঁরা নিয়োগকর্তা  এবং স্থানীয় সচ্ছল ব্যক্তিদের বাড়ি  থেকে চেয়ে এনে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে  বেঁচে যাওয়া বাসি খাবার দিয়ে, পরিবারের চাহিদা পূরণ করেছে। কিন্তু  লকডাউন যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন তারা সেই  খাদ্য সহায়তাটুকুও পাচ্ছিলো না। বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক  পরিচালিতজরিপ গবেষণার তথ্য মতে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম শহরের ৬৯% গৃহস্থালীতে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ পূর্বের তুলনায়কমে গিয়েছিল।[5] আমাদের গবেষণাতেও দেখা গিয়েছে যে অধিকাংশ গৃহকর্মী পূর্বের তুলনায় বর্তমানে খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন এবং প্রায় সকল গৃহকর্মী উল্লেখ করেছেন যে, এখন তারা শুধুমাত্র ভাত এবং আলু মতো খাদ্যের উপরই নির্ভরশীল ছিলেন। এতে গৃহকর্মীরা বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো বেশি অপুষ্টির শিকারহচ্ছেন। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা চিন্তাও গৌণ হয়ে গিয়েছে।

খাদ্যচাহিদা পূরণ করতে যেয়ে কোনো কোনো গৃহকর্মীকে ঋণ  নিতে হয়েছে । তবে এসময়ে কেউ কাউকে ঋণ সহায়তাও দেয় না বলে উল্লেখ করেন অধিকাংশ গৃহকর্মী। ধারে পণ্য ক্রয় করা স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষ ও গৃহকর্মীদের মধ্যে একটি স্বাভাবিক চর্চা, কিন্তু মহামারীকালে সেই ব্যবস্থাটিও অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে যায় আয়ের অনিশ্চয়তার কারণে।

গ্রামে যেতে না পারা গৃহকর্মীদের আরেকটা বড় সংকট ছিল বাসস্থান টিকিয়ে রাখা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদেরভাবনা ছিল, কিছু দিনের মধ্যে কাজটি পেয়ে যাব, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তাঁরা তাঁদের নিয়োগকর্তাদের কাছথেকে প্রাপ্ত সহযোগিতা,  আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করা টাকা, এবং কিছুকিছু ক্ষেত্রে সামান্য  সঞ্চয়ব্যবহার করে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করছেন ।

এভাবেই ভুক্তভোগী গৃহকর্মীরা করোনা মহামারীর প্রথমদিকে টিকে থাকতে চেষ্টা করেছেন।  কিন্তু মহামরী দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায় তাঁদের টিকে থাকার সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। গৃহকর্মীর মত নিম্নআয়ের মানুষের  সঞ্চিত পুঁজির পরিমাণ খুবই সামান্য। করোনার প্রথম ধাক্কায় তাদের এই সঞ্চয়টুকু দ্রুত ফুরিয়ে গেছে।

এই পরিস্থিতিতে কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ সুরক্ষা নীতিমালার সময় উপযোগী প্রয়োগ ব্যতিরেকে গৃহকর্মীর মত অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশায় নিয়োজিত বিপুল জনগোষ্ঠী এবং তাদের ওপর নির্ভশীল মানুষগুলোর জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

গৃহকর্মীদের  টিকে থাকার জন্য এই পেশার কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ এবং কাঠামোগত নীতিমালার আওতায় আনার মাধ্যমে তাঁদেরকে ন্যূনতম সুরক্ষা প্রদান করা আবশ্যক। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও এগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হলে  করোনাভাইরাস সংক্রমণসহ অন্যান্য আপদকালীন সময়ে গৃহকর্মীরা কিছুটা হলেও পেশাগত সুরক্ষা পাবেন। এরফলে তাঁদের টিকে থাকার প্রক্রিয়াটি সহজ হবে।

২০১৮ সালে  প্রণীত সংশোধিত শ্রম আইনে কৃষি শ্রমিকদেরকে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এবং গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমজীবীদের শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হয় নি।[6]  প্রাতিষ্ঠানিকক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকেরা করোনা মহামারীকালীন সময়ে  ন্যূনতম হলেও জাতীয় সুরক্ষানীতির আওতাভুক্ত হয়েছে।  কিন্তু গৃহকর্মীসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকরা উল্লেখযোগ্য সুরক্ষা নীতিমালার  আওতাভুক্ত হয়নি।[7] ফলে কাজ হারিয়ে দিন দিন তাঁরা  দারিদ্র থেকে অতিদারিদ্রতার  দিকে ধাবিত হচ্ছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এর করা জরিপ  তথ্য অনুসারে চলমান মহামারীর ফলে ২.১ কোটি লোক নতুন করে দরিদ্র হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।[8] বিশেষত গৃহকর্মীরা তাঁদের পেশার ধরণের কারণে রয়েছেন ঝুঁকির মুখে। তাই তাঁদেরকে আপদকালীন সময়ে গার্মেন্টসকর্মী সহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের মতবিশেষ  সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদান করতে হবে। কারন দিন শেষে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আপদকালীন সময়ে পেশাগত জীবন এবং আয়ের সুরক্ষা গৃহকর্মীসহ সকল খেটে খাওয়া শ্রমজীবি মানুষের অধিকার।


Taslima Aktar is a Research Associate in the Gender and Social Transformation cluster at BIGD.

 

[1] “COVID-19 and Its Economic Toll on Women-The story behind the numbers”. UN Women. September 16, 2020.

[2] নিরাপত্তাহীনতার মূল্যঃ বাংলাদেশের ঢাকা সামাজিক সুরক্ষা ও পরিষেবায় গৃহশ্রমিকদের প্রবেশাধিকার। পলিসি ব্রিফ – সেপ্টেম্বর ২০। ডোমেস্টিক ওয়ার্কারেস রাইটসনেটওয়ার্ক ।

[3] “ILO Report on Decent Work Deficits in Domestic Work in Bangladesh.” March 4, 2019.

[4] নিরাপত্তাহীনতার মূল্যঃ বাংলাদেশের ঢাকা সামাজিক সুরক্ষা ও পরিষেবায় গৃহশ্রমিকদের প্রবেশাধিকার। পলিসি ব্রিফ – সেপ্টেম্বর ২০। ডোমেস্টিক ওয়ার্কারেস রাইটসনেটওয়ার্ক।

[5] “Covid-19 Fallout: 68% Lost Jobs in Dhaka and Ctg,” The Daily Star. September 28, 2020.

[6] “ILO Report on Decent Work Deficits in Domestic Work in Bangladesh.” March 4, 2019.

[7] নিরাপত্তাহীনতার মূল্যঃ বাংলাদেশের ঢাকা সামাজিক সুরক্ষা ও পরিষেবায় গৃহশ্রমিকদের প্রবেশাধিকার। পলিসি ব্রিফ – সেপ্টেম্বর ২০২০। ডোমেস্টিক ওয়ার্কারেসরাইটস নেটওয়ার্ক।

[8] “COVID-19 Shatters Bangladesh’s Dream of Eradicating Poverty.” Accessed May 17, 2021.

Up