Blog

আমিন ভাই ও ব্র্যাক : চলার বেগেই পথ কেটে যায় (প্রথম পর্ব)

এদেশের তরুণদের একটা বিশাল অংশ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। স্বাধীনতার পরপর এই তরুণদের অনেকেরই ভাবনা ছিল দেশ পুনগর্ঠনে কাজ করা। এঁদের অনেকেই তখন যুতসই একটা প্ল্যাটফর্ম খুঁজছিলেন  যার মাধ্যমে তাঁরা  দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, এবং একটি শোষণমুক্ত ও ন্যায়বিচারসম্পন্ন সমাজ গড়ার কাজে নিয়োজিত হতে পারতেন। একই লক্ষ্য নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে স্যার ফজলে হাসান আবেদ প্রতিষ্ঠা করেন ব্র্যাক। খুব দ্রুতই ব্র্যাক মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা একটা সচেতন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। অজস্র তরুণ দেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যুক্ত হয় ব্র্যাকে। পরবর্তীতে এদের অনেকের কাছে ব্র্যাক-ই হয়ে ওঠে জীবন। মোঃ আমিনুল আলম এদেরই একজন, আমিন ভাই নামেই যিনি ব্র্যাক মহলে পরিচিত।

আমিন ভাই ১৯৭৫ সালের ১লা এপ্রিল কর্মসূচী তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ব্র্যাকে যোগদান করেন। ২০১০ সালের ২রা অক্টোবর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্র্যাকের সাথে তাঁর সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের কর্মজীবনের অবসান ঘটে।এই দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি ব্র্যাকের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপালন করেন। প্রকল্প প্রশাসক, আঞ্চলিক ও ঊর্ধ্বতন আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক, কর্মসূচী সমন্বয়কারী, পরিচালক এবং উপ-নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ব্র্যাক আন্তজার্তিক কর্মসূচীর নির্বাহী পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ব্র্যাকের বিভিন্ন কাল পর্বে প্রতিষ্ঠানটির বিকাশ ও ব্যাপক বিস্তৃতিতে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ব্র্যাকে তাঁর বিপুল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ব্র্যাকের ফিল্ড মার্শাল’ ‘মাঠের মানুষ’ সহ বহু বিশেষণে তাঁকে ভূষিত করা হয়। ২০১৮ সালে অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘মাঠের মানুষ: স্মরণে মোঃ আমিনুল আলম’ শীর্ষক স্মারক গ্রন্থে তাঁকে নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন তাঁর সহকর্মীরা।

ব্র্যাকের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে সম্প্রতি ‘ফ্রিডম ফ্রম ওয়ান্ট’ বইয়ের লেখক ইয়ান স্মাইলি কর্তৃক গৃহীত আমিনুল আলম (আমিন)-এর একটি সাক্ষাৎকারের সন্ধান পাই আমরা। এই সাক্ষাৎকারে তাঁর ব্র্যাকে যোগদান, মানিকগঞ্জ সমন্বিত প্রকল্প, আড়ং, -এর সূচনা, সত্তর দশকের শেষভাগে ব্র্যাকের কৌশলগত পরিবর্তন, আরডিপি’র শুরুর গল্প সহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। গত ২ অক্টোবর ছিল আমিন ভাইয়ের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ক্ষুদ্র পরিসরে আমিন ভাইয়ের কাজের বিপুল পরিধি তুলে ধরা সম্ভব নয়। দুই পর্বের এই লেখার মাধ্যমে আমরা আমিন ভাইয়ের শুরুর দিকের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রথম পর্বে রইলো আমিন ভাইয়ের ব্র্যাকে যোগদানের গল্প, রৌমারী, শাল্লা, জামালপুর, মানিকগঞ্জ- এর অভিজ্ঞতা, এবং আড়ং- শুরুর গল্প।

ব্র্যাকে যোগদানের গল্প ও রৌমারীর অভিজ্ঞতা

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে এই দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করলে ব্র্যাক রংপুরের রৌমারীতে জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ কর্মসূচি শুরু করে। ব্র্যাক-এর পরিকল্পনা ছিল ত্রাণ কার্যক্রম শেষ হলে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করা। এই কর্মসূচীটি পরিচালনা করার জন্য ব্র্যাক তখন একজন প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর খোঁজ করছিল। একই সময় তরুণ আমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরিচিত একজনের কাছে ব্র্যাক সম্পর্কে জানতে পেরে এফ এইচ আবেদের সঙ্গে তিনি দেখা করতে যান। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর আবেদ ভাই ৫০০ টাকা বেতনে তাঁকে রৌমারীতে চাকরির প্রস্তাব দেন এবং এক পর্যায়ে তিনি রাজি হন। অবশ্য বেতন নিয়ে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর কিছুটা দরকষাকষিও হয়। সুদীর্ঘ চাকরী জীবনে বেতন নিয়ে আবেদ ভাইয়ের সাথে এটাই তাঁর প্রথম ও শেষ দরকষাকষি বলে জানান তিনি। আমিন ভাইকে নিয়ে এক স্মৃতিচারণায় এফ এইচ আবেদ লেখেন:

‘১৯৭৫ সালে আমিনুল আলম আমার কাছে আসে। তাঁর ইচ্ছে সে ব্র্যাকে কাজ করবে। আমিনের সঙ্গে আমি কথা বলি। আমিনকে দেখে প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল, সে অত্যন্ত পরিশ্রমী, কাজ করবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বেশ আগ্রহ নিয়েই আমিনকে আমি ব্র্যাকে নিয়োগ দেই।’

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমিন ভাই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে প্রায়শই তাকে পার্টির কাজে গ্রামগঞ্জে যেতে হতো। মানুষের সাথে কথাবার্তা বলতে হতো। এর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর আগে থেকেই ছিল। কিন্তু রৌমারীতে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা পাল্টে যায়। শহুরে উচ্চবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া আমিন অনুভব করেন রৌমারীতে তিনি জীবনে প্রথমবারের মত সত্যিকারের দরিদ্র মানুষের মুখোমুখি হয়েছেন । তিনি বুঝতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ‘দরিদ্র’ বলতে যাদের বুঝতেন তারা আদতে ‘দরিদ্র’ ছিল না। এমনকি ওই সময়ের বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিকদলগুলোও প্রকৃত দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করছিল না। রৌমারীর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তাঁর বয়ানে আমরা পাই:

‘রৌমারীতে যখন সত্যিকারের দরিদ্র মানুষের মুখোমুখি হলাম, এটা আমার মানসিকতা পরিবর্তন করে দিল। আমার মনে হলো কমিউনিস্টরা প্রকৃত দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করছে না। তারা কাজ করে গ্রামের কিছু ধনী মানুষ এবং প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে, এবং জাহির করে যে তারা দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে ওরা মূলত মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ।’

এর আগে ছয় বছর তিনি কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করেছেন, ফলে তিনি এও উপলব্ধি করেন যে রৌমারী প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকৃত দরিদ্ররা উপকৃত হচ্ছে না। কারণ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের দলীয় লোকজনদের ত্রাণ বিতরণ করছিলেন যারা সেই অর্থে দরিদ্র ছিল না। এই বিষয়গুলো নিয়ে তখন ব্র্যাকের সাথে স্থানীয় মোড়লদের দ্বন্দ্ব হয় এবং সেই সাথে প্রকল্প পরিচালনার কাজে ব্র্যাকের কিছু কর্মীর অসহযোগীতাপূর্ণ আচরণও লক্ষ্য করা যায়। তারা বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছিল ঠিকই, দরিদ্র মানুষদের সাথে কথা-বার্তাও বলছিল কিন্তু সঠিক কাজটি তারা করছিল না। বিষয়টি আমিন ভাইয়ের নজরে আসে। এরপর আবেদ ভাই রৌমারীতে যান এবং একদিন সকাল সাতটা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত এ বিষয়গুলো নিয়ে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে ব্র্যাক-কর্মীদের আলোচনা হয়। তারা আবেদ ভাইকে সার্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। এবং এক পর্যায়ে রৌমারী থেকে ব্র্যাক কার্যক্রম প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়।

শাল্লা, জামালপুর, মানিকগঞ্জ

আমিন ভাই রৌমারীতে চারমাস ছিলেন। রৌমারী কর্মসূচী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁকে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে শাল্লার টানাখালি ব্রাঞ্চে বদলি করে দেওয়া হয়। সেখানে যোগ দেওয়ার আগে ছুটি নিয়ে যখন ঢাকায় আসেন তখন অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি বাবামাকে হারান। ফলে পুরো পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাধে এসে পড়ে এবং তিনি সঠিক সময়ে সিলেটে যোগ দিতে ব্যর্থ হন। এ সময় তিনি ঢাকা কিংবা ঢাকার আশেপাশে চাকরির খোঁজ করছিলেন যেন তিনি একই সাথে পরিবারের দেখভালও করতে পারেন। এ পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, আমিন ভাই অক্সফামের কর্মকর্তা কোল প্যাট্রিক ডজ-এর কাছে চাকরি প্রাপ্তির বিষয়ে সহযোগিতা কামনা করছেন। উল্লেখ্য, ব্র্যাকের রৌমারী প্রকল্পে তহবিল প্রদান করেছিল অক্সফাম। সেই সূত্রে আমিন ভাইয়ের সাথে কোলের পরিচয় এবং উনার সাথে ব্র্যাকের সুসম্পর্ক ছিল। ওই সময় এক সহকর্মীর আত্মীয়ের মাধ্যমে কনসার্নএর এক কর্মকর্তার সাথে আমিন ভাই দেখা করেন এবং নারায়ণগঞ্জের ডেমরায় একটা চাকরির ব্যাপারে তাদের কথাবার্তা হয়। এরপর কনসার্ন কর্মকর্তারা আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন এবং আমিন ভাই সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। আবেদ ভাই তখন আমিন ভাই সম্পর্কে তাদেরকে প্রশংসাসূচক কথা বলেন এবং তাঁকে কনসার্ন-এ নেয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করেন। ফিরে এসে কনসার্নের ওই কর্মকর্তা আমিন ভাইকে জানান যে আবেদ ভাই তাঁর সম্পর্কে বেশ ইতিবাচক। তবে  তিনি কেন ব্র্যাকে যোগদান করছেন না এ নিয়ে ঐ কর্মকর্তা বিষ্ময় প্রকাশ করেন। আমিন ভাইএর কাছ থেকে কারণ জানার পর ওই কর্মকর্তা তাঁকে জানান যে  ব্র্যাক নতুন কিছু কর্মসূচী শুরু করেছে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছে, এবং ভালো বেতন দিচ্ছে । তিনি তখন আমিন ভাইকে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন। পরামর্শ মোতাবেক আমিন ভাই আবার আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যান। আমিন ভাইয়ের সার্বিক অবস্থার কথা জানার  পর  আবেদ ভাই তাঁকে জানান যে, তিনি চাইলে জামালপুরে যোগ দিতে পারেন। ব্র্যাক সেখানে একটা মহিলা কর্মসূচী শুরু করেছে যেটা ঢাকা থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এরপর আবেদ ভাই তাঁকে খুব দ্রুত জামালপুর চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আবেদ ভাইয়ের নির্দেশ মোতাবেক তিনি ইউনিসেফের একটা দলের সাথে জামালপুরে চলে যান এবং সেখানে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। উল্লেখ্য, ইউনিসেফ জামালপুরে মহিলা কর্মসূচী শুরু করার আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল এবং ওই সময় খুশি কবির ছিলেন জামালপুরের দায়িত্বে। জামালপুরে কিছুদিন থাকার পর আমিন ভাই বুঝতে পারেন, সেখানে তাঁর জন্য কোন পদ খালি  নেই। বিষয়টি খুশি কবিরের মাধ্যমে আবেদ ভাইকে জানালে, আবেদ ভাই তাঁকে অতিদ্রুত মানিকগঞ্জে পাঠানোর নির্দেশ দেন। অচিরেই মানিকগঞ্জ হয়ে ওঠে ব্র্যাক তথা আমিন ভাইয়ের কাজের প্রধান ক্ষেত্র।

উল্লেখ্য, শাল্লার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭৬ সালে ব্র্যাক মানিকগঞ্জে একটি সমন্বিত প্রকল্প হাতে নেয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন আয়-উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে যুক্ত করে সমন্বিত পল্লী উন্নয়নই ছিল মানিকগঞ্জ কর্মসূচীর মূল উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে ব্র্যাক সেখানে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল, ভূমি সীমাবদ্ধতার কারণে শাল্লায় করা যেটা সম্ভব ছিল না। আমিন ভাই যখন মানিকগঞ্জে যান তখন সেখানে ব্র্যাকের ‘ফুড-ফর-ওয়ার্ক’ প্রোজেক্ট চলছিল। চারদিকে মানুষের করুণ অবস্থা দেখে তিনি বিমুঢ় হয়ে পড়েন। তিনি ভাবেন এই মানুষগুলোর জন্য তাঁকে কিছু একটা করতে হবে। মাত্র এক মাসের অ্যাসাইনমেন্টে মানিকগঞ্জ গেলেও সেখানে তিনি পরবর্তী ৮-৯ বছর অতিবাহিত করেন।

মানিকগঞ্জে যাওয়ার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা আমিন ভাইয়ের বয়ানে পাই:

এ-রকম শীর্ণ মানুষ আমি জীবনে কখনও দেখি নি। আমি এটা বিশ্বাস-ই করতে পারছিলাম না। আমি কখনো ভাবি নি যে এ-রকম মানুষজন এখনও ওখানে আছে। তারা রীতিমত গাছের ছালবাকল রান্না করে খাচ্ছিল। অনেক মহিলা শ্রমিক মাঠে কাজ করছিল। এটা আমার জন্য একটা হৃদয় বিদারক দৃশ্য ছিল। তখন মনে হলো আমাকে কিছু একটা করতে হবে। আমাকে এখানে কাজ করতে হবে।ওখানকার মানুষজনের জন্য কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, আহারে আমি যদি এই মানুষগুলোর জীবন পাল্টে দিতে পারতাম।

মানিকগঞ্জে যাওয়ার পর আমিন ভাই নারীর ক্ষমতায়নের উপর বিশেষভাবে জোর দেন এবং উপলব্ধি করেন নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি বিশেষভাবে জরুরি। ‘ফুড-ফর-ওয়ার্ক’ প্রোজেক্টে অনেক নারী শ্রমিক কাজ করছিলেন। আমিন ভাই তাঁদের কাছে জানতে চান, প্রোজেক্ট শেষ হলে তাঁরা  কি করবেন । তখন ওই নারীরা জানান যে তারা তাঁদের  আগের কাজে ফিরে যাবেন। অর্থাৎ তাঁরা ভিক্ষা করবেন । বিষয়টি আমিন ভাইয়ের মনে দাগ কাটে এবং তিনি অতি দ্রুত এইসব নারীদেরকে বিভিন্ন আয়-উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে যুক্ত করার উদ্যোগ নেন। যেমন হাঁসমুরগী পালন, রেশম চাষ, আচার তৈরী, চানাচুর তৈরী, কাঁথা সেলাই, হাতের কাজ, ইত্যাদি। যেহেতু নতুন করে দক্ষতা তৈরি সময়সাপেক্ষ, তাই তিনি সে কাজগুলোকেই বেছে নেন যে কাজে গ্রামীণ নারীরা সিদ্ধহস্ত। একই সঙ্গে তিনি ব্যবহারিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। আমিন ভাইয়ের নেতৃত্বে অচিরেই মানিকগঞ্জের নারীরা সংগঠিত হয়ে বিভিন্ন রকম আয়-উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে যুক্ত হন। ব্র্যাক তাদের সবরকমের সহায়তা প্রদান করে।

আড়ং-এর শুরু

     মানিকগঞ্জ থেকে ব্র্যাকের অনেক উদ্যোগ পরবর্তীতে ব্যাপক সাফল্য ও স্থায়ীত্ব লাভ করে, যার একটি হচ্ছে আড়ংআড়ং প্রতিষ্ঠায়ও আমিন ভাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আড়ং শুরুর পেছনে একটা গল্প আছে যা ইয়ান স্মাইলি গৃহীত আমিন ভাইয়ের সাক্ষাৎকারে আমরা পাই। সেটা হচ্ছে, মানিকগঞ্জে ব্র্যাক যখন ‘বয়স্ক-শিক্ষা কর্মসূচী’ শুরু করে তখন এই কাজে বেশ কিছু ‘শিক্ষাসেবিকা’ নিয়োগ দেয়া হয়। তাঁরা ছিলেন ‘ইউথ ফোরাম’-এর সদস্য যাঁরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এই কাজটি করছিলেন। ‘বয়স্কশিক্ষা কর্মসূচী’ শেষ হয়ে গেলে তাঁরা বেকার হয়ে পড়েন। এঁদের অধিকাংশই ছিলেন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। তখন তাঁরা আমিন ভাইকে বলেন যে, বিগত ছয় মাস তাঁরা এই কাজটি বিনামূল্যে করেছেন কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন কাজ শেষ হওয়ার পর তাঁরা কিছু পাবেন। তাঁরা আমিন ভাইয়ের কাছে দাবী তোলেন ফোরামকে সংগঠিত করে তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে। তাঁরা বাড়িতে বেকার বসে থাকার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। আমিন ভাই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে চিন্তা করেন। ওই সময়ে একটা সার্ভের কাজে মানিকগঞ্জে যান মার্থা চেন ও অন্যান্যরা। আমিন ভাই সহ তাঁরা গাড়িতে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করছিলেন। হঠাৎ রাস্তায় তাঁদের গাড়ির চাবি হারিয়ে যাওয়ায় যাত্রাবিরতিতে তাঁরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপআলোচনা করছিলেন। এ সময় আমিন ভাই মার্থা চেন সহ অন্যান্যদের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং জানান  যে এই নারীরা বিভিন্ন রকমের হাতের কাজে বেশ দক্ষ। তিনি প্রশ্ন করেন এদের জন্য কোন ধরণের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যায় কিনা। তাঁরা আমিন ভাইকে  এব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা করার কথা বলেন। এরপর ঢাকায় এসে তাঁরা কারিকার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের সহায়তায় কারিকা থেকে কিছু এমব্রয়ডারির কাজ পাওয়া যায় এবং এমব্রয়ডারি করার জন্য নমুনা হিসেবে কিছু নকশা দেওয়া হয়। ব্র্যাক কারিকার চাহিদা অনুযায়ী গ্রামীণ নারীদের উৎপাদিত বিভিন্ন কারুপণ্য সরবরাহ করা শুরু করে।

এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর একবার কারিকা পছন্দ না হওয়াও কিছু অর্ডার বাতিল করে দেয়। কারিকার ভোক্তারা ছিল শহরকেন্দ্রিক, ফলে গ্রামীণ মোটিফ তাদের পছন্দ হয় নি। এছাড়া আরও একটা সমস্যা দেখা দেয়। কারিকা থেকে বিল পেতে তিনচার মাস সময় লেগে যেত। কারণ তখন ব্যাংকিং পদ্ধতি এতটা উন্নত ছিল না। কারুপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন দরিদ্র নারীরা। একটা বিলের জন্য তাদের তিন-চার মাস অপেক্ষা করা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিষয়টি উপলব্ধি করে আমিন ভাই কিভাবে এর সমাধান করা যায় তা নিয়ে আয়েশা আবেদ এবং মার্থা চেনের সঙ্গে আলাপ করেন। তিনি তাঁদেরকে জানান যে ব্র্যাকে একটি নিজস্ব কারুপণ্যের দোকান প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এগুলো সেখানে বিক্রী করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে দরিদ্র নারীদের দ্রুত মজুরি প্রাপ্তির পথও সুগম হবে। পরবর্তীতে মার্থা চেন এবং আয়েশা আবেদ বিষয়টি নিয়ে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করেন। আবেদ ভাই তখন এমসিসি(মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটির)-এর  সাথে কথা বলেন। উল্লেখ্য, তখন এমসিসিও একই রকম পণ্য উৎপাদন করতো। এরপর ব্র্যাক এবং এমসিসি মিলে ধানমন্ডিতে আড়ং বিপণী শুরু করে এবং গ্রামীণ নারীদের উৎপাদিত সব পণ্য ব্র্যাকের নিজস্ব বিপণী আড়ং-এ নিয়ে আসা হয়। দরিদ্র কর্মীরাও যথাসময়ে তাদের মজুরি পাওয়া শুরু করে।

 

শুরুতে আড়ং অল্প পরিসরে শুরু করলেও ধীরেধীরে এর ব্যাপ্তি বাড়ে। এ প্রসঙ্গে আমিন ভাইয়ের বয়ানে আমরা পাই:

ধানমন্ডিতে ছোট্ট একটা দোকান ছিলআড়ং। এরপর দ্বিতীয় দোকানটার জন্য আমরা দুইতলা একটা বিল্ডিং ভাড়া নেই। একতলার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং দোতলার কাজ চলছিল। এরপর আমরা আড়ংকে আসাদ-গেটে শিফট করি। এভাবে আড়ং ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। তো সেদিনের সেই চাবি হারানোর ঘটনাই কিন্তু আড়ং ধারণার উদ্ভব হতে সাহায্য করেছিল।


লেখক রাব্বী আহমেদ, জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে যুক্ত আছেন বিআইজিডি ও ব্র্যাক-এর যৌথ উদ্যোগে চলমান ‘ব্র্যাক ইতিহাস প্রকল্প’-এ। প্রকল্পটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান এবং ড. ইমরান মতিন।

তথ্যসূত্র-
১) ইয়ান স্মাইলি গৃহীত আমিনুল আলম (আমিন)-এর সাক্ষাৎকার

২) মাঠের মানুষ : স্মরণে মোঃ আমিনুল আলম; অন্যপ্রকাশ, ২০১৮

৩) ব্র্যাক : উন্নয়নের একটি উপাখ্যান; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৯

৪) শাহাদুজ্জামান গৃহীত সুখেন্দ্রকুমার সরকারের সাক্ষাৎকার

৫) ফ্রিডম ফ্রম ওয়ান্ট, ইয়ান স্মাইলি; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৯

৬) ব্র্যাক-বিআইজিডি গৃহীত রেখা বেগমের সাক্ষাৎকার।

Up